Monday, 27 December 2021

মা সরদার জন্মদিন উপলক্ষ্যে


 


❤️🙏💐শুভ জন্মদিন মা💐🙏❤️

✍️🌻🌼🌹🌿
বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত জয়রামবাটী একটি ক্ষুদ্র গ্রাম। এই গ্রামের শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও শ্যামাসুন্দরী দেবীর প্রথম সন্তান শ্রীশ্রীমা সারদামণি দেবী। পুরুষানুক্রমে রামচন্দ্রের উপাসক শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ। পত্নী শ্যামাসুন্দরী দেবীও ঠিক সেরকম। মা বাবার প্রসঙ্গে স্বয়ং সারদাদেবী বলেছেন, 'আমার বাপ-মা বড় ভালো ছিলেন। বাবা বড় রামভক্ত ছিলেন। নৈষ্ঠিক—অন্য বর্ণের দান নিতেন না। মায়ের কত দয়া ছিল–লোকদের কত খাওয়াতেন, যত্ন করতেন— কত সরল! বাবা তামাক খেতে খুব ভালবাসতেন। তা এমন সরল, অমায়িক ছিলেন যে, যে কেউ বাড়ির কাছ দিয়ে যেত ডেকে বসাতেন, আর বলতেন, “বস ভাই, তামাক খাও।” এই বলে নিজেই ছিলিম ছিলিম তামাক সেজে খাওয়াতেন। বাপ-মায়ের তপস্যা না থাকলে কি (ভগবান) জন্ম নেয়?

                            🌾🍁🍂☘️🌱

সমাজে তখন নগরায়ণের দিকে ঝোঁক। গ্রাম থেকে অর্থ উপার্জনের জন্য মানুষ নগরমুখী। রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ও আর্থিক সচ্ছলতার জন্য কলকাতায় উপস্থিত হলেন। স্বামী কাজের খোঁজে শহরে গিয়েছেন, শ্যামাসুন্দরী তাই বাপের বাড়ি শিহড়ে। জয়রামবাটীর কাছেই এই শিহড়। সেখানে শ্যামাসুন্দরী দেবীর এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। একদিন অসুস্থ অবস্থায় অন্যান্য গ্রাম্য বধূর মতোই পুকুরের পাড়ে শৌচে গেছেন শ্যামাসুন্দরী দেবী। প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থা। এমন সময় কুমোরদের পোয়ানের (মাটি শুকোবার স্থান) কাছে ঝন্‌ঝন্ শব্দে সচকিত হয়ে উঠলেন তিনি। তাকিয়ে দেখলেন, সামনের বেলগাছ থেকে একটি শিশুকন্যা নেমে এল এবং তার নরম কোমল দুটি হাত দিয়ে শ্যামাসুন্দরীর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি তোমার ঘরে এলাম, মা।' শ্যামাসুন্দরী সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন। জ্ঞান ফিরলে অনুভব করলেন ঐ কচি মেয়েটি যেন তাঁর গর্ভে প্রবেশ করেছে।
এরপর ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার সারদাদেবীর জন্ম। (বাংলা তারিখ : ৮ পৌষ, ১২৬০ বঙ্গাব্দ, কৃষ্ণাসপ্তমী তিথি। সময় : রাত্রি, ২ দণ্ড ৯ পল।)

                            🌾🍁🍂☘️🌱   

🌺🌿 শ্রী শ্রী মায়ের পুণ্য জীবনে অনেক ঘটনা আছে, তাঁর জীবনের সব ঘটনা তো বলা সম্ভব নয়, তাই কিছু ঘটনা উপস্থাপন করা হল---

দরিদ্রের সংসারে সারদাদেবীর জন্ম। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তিনি দয়ার মূর্তি। ১৮৬৪-৬৫ খ্রীষ্টাব্দে বাংলায় করাল দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। দেশজুড়ে অন্নের জন্য হাহাকার। রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় দরিদ্র হলেও পরম দয়ালু। দুর্ভিক্ষের অন্নকষ্ট তাঁকে ব্যথিত করল। নিজেদের জন্য মরাই-ভর্তি যে ধান জমিয়ে রেখেছিলেন, তা দিয়ে অন্নসত্ৰ খুললেন। চালে-ডালে খিচুড়ি রাঁধতেন আর দলে দলে লোক এসে খেত। ক্ষুধার্ত মানুষের পাতে যখন গরম গরম খিচুড়ি ঢেলে দেওয়া হত, তখন ছোট্ট সারদা তাঁর ছোট দুহাত দিয়ে পাখার বাতাস করতেন—খিচুড়ি ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য। কেউ তাঁকে বলে দেয়নি। তিনি নিজে নিজেই তা করতেন।

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

রামচন্দ্র মুখুজ্যেদের কয়েক বিঘা জমি ছিল, কিন্তু তাতে যে ধান হত তা যথেষ্ট ছিল না। রামচন্দ্র তাই সংসার প্রতিপালনের জন্য পুরোহিতের কাজ করতেন এবং তুলোর চাষ করাতেন। শ্যামাসুন্দরী দেবী কোলের মেয়ে সারদাকে ক্ষেতে শুইয়ে তুলো তুলতেন। একটু বড় হয়ে সারদাও মাকে ঐ কাজে সাহায্য করতেন। মা-মেয়ে দুজনে ঐ তুলো থেকে পৈতে তৈরী করতেন বিক্রির জন্য। ছোট-ভাইদের দেখাশুনো করা তাঁর আর এক কাজ ছিল। ভাইদের নিয়ে তিনি আমোদর নদে স্নান করতে যেতেন। কখনও বা গলা সমান জলে নেমে গরুর জন্য দলঘাস কাটতেন। ক্ষেতে মুনিষদের জন্য মুড়িও তিনিই নিয়ে যেতেন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন শান্ত ও বুদ্ধিমতী। কাজেও খুব উৎসাহ ছিল। তাঁকে কখনও কোন কাজ করতে বলতে হত না—নিজে থেকেই সব কাজ সুন্দরভাবে গুছিয়ে করতেন। সঙ্গিনীদের সঙ্গে তিনি খেলাধুলো করতেন, কিন্তু খেলাতে তাঁর সঙ্গে কারও ঝগড়া হত না। বরং অন্য মেয়েরা ঝগড়া করলে তিনি এসে তা মিটিয়ে দিতেন। খেলার মধ্যে তাঁর প্রিয় খেলা ছিল, কালী ও লক্ষ্মী প্রতিমা গড়ে ফুল-বেলপাতা দিয়ে পুজো করা।

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

সারদা তখন পাঁচ বছর অতিক্রম করে ছ-বছরে পড়েছেন। আর ওদিকে দক্ষিণেশ্বরে কামারপুকুরের গদাধর চট্টোপাধ্যায়—ভবিষ্যতের শ্রীরামকৃষ্ণ—সাধনার তোড়ে ভেসে চলেছেন। জগজ্জননীর দর্শন না পেয়ে তিনি থামবেন না। অবশেষে একদিন ব্যাকুলতার বেদনায় মায়ের হাতের খড়া তুলে নিয়ে মায়ের চরণেই যখন আত্মাহুতি দিতে উদ্যত হলেন, মা দেখা দিলেন তখন। এরপর থেকে জগজ্জননী তাঁর কাছে জীবন্ত হয়ে উঠলেন— আর তিনি মন্দিরের পাষাণ প্রতিমা নন। মায়ে ছেলের এক অপূর্ব দিব্যলীলা অভিনীত হয়ে চলল দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে যে খেলা জগৎ আর কখনও দেখেনি। কিন্তু সাধারণ লোকের পক্ষে সেই দিব্যলীলা বোঝা সম্ভব নয়। তাদের চোখে গদাধর পাগল বলে প্রতিপন্ন হলেন। গদাধরের ‘মস্তিষ্কবিকৃতি’র খবর কামারপুকুরেও এসে পৌঁছল। মা চন্দ্ৰমণি দেবী তাঁকে দক্ষিণেশ্বর থেকে গ্রামে নিয়ে এলেন এবং তাঁর ঈশ্বর-পাগল মনকে সংসারমুখী করার জন্য তাঁর বিবাহের চেষ্টা করতে লাগলেন। পাত্রীর সন্ধান খুব গোপনে চলতে লাগল পাছে গদাধর জানতে পেরে বেঁকে বসেন। কিন্তু যখন তিনি জানতে পারলেন, তখন তিনি বিরক্ত তো হলেনই না, উপরন্তু বাড়িতে এই ধরনের বিবাহ অনুষ্ঠান হলে বাড়ির শিশুরা যেমন আনন্দ করে, সেরকম আনন্দ করতে লাগলেন। কিন্তু খোঁজ-খবর করেও মনোমতো পাত্রী কিছুতেই পাওয়া গেল না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে গদাধর তখন বলে বসলেন : ‘এদিক ওদিক খুঁজে কি হবে? জয়রামবাটীর রামচন্দ্র মুখুজ্যের বাড়িতে দেখগে, বিয়ের কনে সেখানে “কুটোবাঁধা” আছে।” অর্থাৎ সারদাদেবী তাঁর জন্যই নির্দিষ্ট হয়ে আছেন, ঠিক যেভাবে গাছের কোন ফলকে কুটো বেঁধে অন্য ফলের থেকে আলাদা করে রাখা হয় দেবতাকে নিবেদন করার জন্য|

                        ❤🌾🍁🍂☘️🌱 ❤

এর কয়েকবছর আগে শিশু সারদাও একদিন শ্রীরামকৃষ্ণকে পতিরূপে নির্বাচন করেছিলেন কোন কিছু না বুঝেই। শিহড় সারদাদেবীর মামাবাড়ী। শ্রীরামকৃষ্ণের ভাগ্নে হৃদয়রাম মুখোপাধ্যায়েরও বাড়ি শিহড়ে। গ্রামের এক ধর্মীয় সঙ্গীতানুষ্ঠানে বহু লোকের মধ্যে ঘটনাচক্রে গদাধর উপস্থিত আছেন। আবার একটু দূরে কোন এক মহিলার কোলে শিশু সারদাও বসে আছেন। গান শেষ হলে ঐ মহিলা মজা করে সারদাকে জিজ্ঞেস করলেন : 'এই যে এত লোক এখানে রয়েছে, এদের মধ্যে কাকে তোর বিয়ে করতে ইচ্ছে হয়, বল তো?” অমনি শিশু-সারদা দু-হাত তুলে শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখিয়ে দিলেন। এইভাবে কোন এক দৈব-প্রেরণায় এঁরা দুজনেই দুজনকে নির্বাচন করে নিয়েছিলেন। অবশেষে ১২৬৬ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসের শেষে চব্বিশ বছরের গদাধরের সঙ্গে ছয় বছরের সারদামণির বিবাহ সম্পন্ন হল। তখনকার প্রথা অনুযায়ী পাত্রপক্ষ কন্যাপক্ষকে পণ দিল তিনশ টাকা। পরবর্তীকালে বিবাহের প্রসঙ্গে শ্রীমা বলতেন, ‘খেজুরের দিনে আমার বিয়ে হয়, মাস মনে নেই। দশ দিনের মধ্যে যখন কামারপুকুর গেলুম তখন সেখানে খেজুর কুড়িয়েছি।'

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

বিয়ের পর তেরো ও চোদ্দ বছর বয়সে সারদাদেবী কামারপুকুরে গিয়ে থাকেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তখন দক্ষিণেশ্বরে সাধনায় মগ্ন। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গেই বিরাট হালদারপুকুর, চট্টোপাধ্যায় পরিবারসহ সমস্ত গ্রামের মানুষেরই প্রয়োজন মেটায় ঐ পুকুরের জল। এদিকে ছোট্ট সারদা নববধূ, মনে মনে। ভাবতেন, কি করে একা একা নাইতে যাব? চিন্তা করতে করতেই দেখতে পেতেন, আটটি মেয়ে কোথা থেকে যেন উপস্থিত হলেন। শ্রীমাও তাঁদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়তেন। মেয়েগুলির মধ্যে চারজন তাঁর আগে, চারজন তাঁর পিছনে পিছনে চলতেন। আর ভয় করত না তাঁর। শ্রীমা হালদারপুকুরে স্নান করতেন, তাঁরাও করতেন। আবার বাড়ি ফিরে আসতেন একইভাবে। শ্রীমা যতদিন কামারপুকুরে ছিলেন, ততদিনই ঐরকম হত। তিনি ভাবতেন, মেয়েগুলি কারা—স্নানের সময় রোজই আসে? তিনি কিন্তু কিছু বুঝতে পারেননি, তাঁদের জিজ্ঞাসাও করেননি কোন দিন!

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

একদিন শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে পরীক্ষাচ্ছলে জিজ্ঞাসা করলেন, "কি গো তুমি কি আমায় সংসারপথে টেনে নিতে এসেছ?” শ্রীমা বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে উত্তর দিলেন, 'না, আমি তোমাকে সংসারপথে কেন টানতে যাব? তোমার ইষ্টপথেই সাহায্য করতে এসেছি।' শ্রীমাও একদিন ঠাকুরের পদসেবা করতে করতে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'আমাকে তোমার কি বলে মনে হয়?' ঠাকুর তার উত্তরে বলেন, 'যে মা মন্দিরে আছেন, তিনিই এ শরীরের জন্ম দিয়েছেন ও এখন নহবতে বাস করছেন, আর তিনিই এখন আমার পদসেবা করছেন। সাক্ষাৎ আনন্দময়ীর রূপ বলে তোমায় সর্বদা সত্য সত্য দেখতে পাই।' এ যে তাঁদের মুখের কথা নয়, অন্তরের সত্যদৃষ্টি, তার অগ্নিপরীক্ষাও শ্রীরামকৃষ্ণ-সারদাদেবী জগতের কাছে দিয়ে গেছেন।

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

১২৭৯ সালের ২৪ জ্যৈষ্ঠ অমাবস্যা তিথিতে ফলহারিণী কালিকাপূজার দিন শ্রীমাকে ষোড়শীরূপে পূজা করলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁর সম্মুখে পূজার নৈবেদ্য প্রদান করে প্রার্থনামন্ত্র উচ্চারণ করলেন, 'হে বালে, হে সর্বশক্তির অধীশ্বরী মা ত্রিপুরসুন্দরী, সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত কর, এঁর (শ্রীমায়ের) শরীর মনকে পবিত্র করে এঁর মধ্যে আবির্ভূতা হও এবং সর্বকল্যাণ সাধন কর।' পূজার মধ্যে শ্রীমা বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়ে সমাধিস্থা হলেন। শ্রীরামকৃষ্ণও অর্ধবাহ্যদশায় মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে সমাধি রাজ্যে চলে গেলেন। সমাধিস্থা দেবীর সামনে সমাধিস্থ পূজক–এইভাবে দীর্ঘক্ষণ কেটে গেল। মাঝ রাতের অনেক পরে শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধি ভাঙল। তখন তিনি নিজেকে, নিজের সাধনার ফল, জপের মালা ইত্যাদি সর্বস্ব ‘দেবী’র পায়ে চিরকালের জন্য বিসর্জন দিয়ে পূজা শেষ করলেন। ক্রমশ শ্রীমা বাহ্যভূমিতে ফিরে এলেন। এই পূজার ফলে শ্রীমা শ্রীরামকৃষ্ণের সমস্ত সিদ্ধির অধিকারী হলেন। যে দেবীশক্তি তাঁর মধ্যে সুপ্ত হয়ে ছিল, এর দ্বারা তার উদ্বোধন হল, যার সাহায্যে তিনি পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণের অসমাপ্ত লোককল্যাণ-ব্রত সম্পূর্ণ করবেন। ষোড়শী পূজার সময় শ্রীমা উনিশ বছরে পদার্পণ করেছিলেন। পত্নীকে জগজ্জননী জ্ঞানে পূজা আধ্যাত্মিক ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম।

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

শ্রীরামকৃষ্ণ নরদেহে ভগবান, শ্রীমাও মানবীরূপে স্বয়ং ভগবতী। ষোড়শী পূজার মাধ্যমে শ্রীরামকৃষ্ণ মায়ের সুপ্ত দেবীত্বকে জাগ্রত করেছিলেন। দেহধারিণী আদ্যাশক্তিকে যেন তাঁর স্বরূপ সম্বন্ধে সচেতন করে দিলেন, যাতে অদূর ভবিষ্যতে তিনি বিশ্বজননী হয়ে তাঁর লোককল্যাণব্রত সম্পূর্ণ করতে পারেন। দেহত্যাগের আগে ঠাকুর স্পষ্টভাবে মাকে সেই দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। কাশীপুরে ঠাকুর যখন ক্যান্সারে অসুস্থ, তখন মাকে একদিন অনেকটা অনুযোগের সুরে বললেন : ‘হ্যাঁগা, তুমি কি কিছু করবে না? (নিজেকে দেখিয়ে) এই সব করবে?' মা বললেন : ‘আমি মেয়েমানুষ, আমি কী করতে পারি?’ ঠাকুর তখনই উত্তর দিলেন, ‘না, না, তোমাকে অনেক কিছু করতে হবে।' কাশীপুরেই আর একদিন ঠাকুর মাকে বলেছিলেন : 'দেখ, কলকাতার লোকগুলো যেন অন্ধকারে পোকার মতো কিলবিল করছে। তুমি তাদের দেখো।' মা আবার বললেন : ‘আমি মেয়েমানুষ! তা কি করে হবে?’ ঠাকুর সেকথায় কান না দিয়ে বললেন : ‘এ (অর্থাৎ তিনি নিজে) আর কি করেছে? তোমাকে এর অনেক বেশী করতে হবে।' এর আগেও ঠাকুর একাধিকবার মাকে বলেছেন : ‘শুধু কি আমারই দায়? তোমারও দায়।

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

ক্রমশ শ্রীরামকৃষ্ণের গলার ক্যান্সার তীব্র হয়ে উঠল। শরীর একেবারে শীর্ণ হয়ে গেল। ডাক্তার-কবিরাজদের চেষ্টা সফল হচ্ছে না দেখে শ্রীমা তারকেশ্বরে হত্যা দিলেন। নিরন্তু উপবাস করে পড়ে রইলেন দুদিন। বিধির বিধানে তৃতীয় দিন রাত্রে শ্রীমার হৃদয়ে জেগে উঠল পরম বৈরাগ্য। মনে হল : ‘এ জগতে কে কার স্বামী? এ সংসারে কে কার?’ ব্রত ভঙ্গ করে ফিরে এলেন তিনি। শ্রীরামকৃষ্ণ রহস্য করে বললেন : “কি গো, কিছু হল?—কিছুই না!”

অবশেষে ৩১ শ্রাবণ (১৬ অগস্ট ১৮৮৬) রাত একটা বেজে দুই মিনিটে শ্রীরামকৃষ্ণ দেহত্যাগ করলেন। পরদিন সন্ধ্যাবেলা মা যখন সব
অলঙ্কার খুলে ফেলে শেষে সোনার বালা জোড়াও খুলতে যাচ্ছেন, ঠাকুর তখন সম্পূর্ণ সুস্থ মূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে তাঁর হাত চেপে ধরলেন, বললেন : ‘আমি কি মরেছি যে, তুমি এয়োস্ত্রীর জিনিস হাত থেকে খুলে ফেলছ?” মা আর বালা খুললেন না। আর তিনি বিধবার বেশ পরেননি। সরু লালপেড়ে কাপড় পরতেন, আর হাতে ঐ দু-গাছা বালা থাকত।

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

জয়রামবাটীতে খাওয়ার পর ভক্তেরা শালপাতা উঠিয়ে স্থান পরিষ্কার করতে গেলে শ্রীশ্রীমা বলতেন, ‘থাক, লোক আছে।' তারপর ঐ কাজটি তিনি নিজেই করতেন। মার আত্মীয়ারা সকল বর্ণের উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করতে চাইতেন না, মাকেও অনুযোগ করে বলতেন, তুমি বামুনের মেয়ে—গুরু, ওরা তোমার শিষ্য; তুমি ওদের এঁটো নাও কেন? মা উত্তর দিতেন, 'আমি যে মা গো, মায়ে ছেলের করবে না তো কে করবে?' স্বামী বিশ্বেশ্বরানন্দ উচ্ছিষ্ট তুলতে গেলে মা তাঁকে হাত ধরে বাধা দিয়ে থালাটা নিজেই নিলেন। বললেন : “আমি তোমার আর কি করেছি? মার কোলে ছেলে বাহ্যে করে, কত কি করে? তোমরা দেবের দুর্লভ ধন।' শ্রীমাকে একদিন উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করতে দেখে নলিনীদি বলেছিলেন, ‘মাগো, ছত্রিশ জাতের এঁটো কুড়ুচ্ছে!” মা শুনে বললেন, 'সব যে আমার, ছত্রিশ কোথা?

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

জনৈক সন্ন্যাসী একদিন শ্রীশ্রীমাকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি মঠের সাধুদের সন্ন্যাস-নাম ধরে ডাকেন না কেন? মা উত্তর দেন, আমি মা কিনা, সন্ন্যাস-নাম ধরে ডাকতে প্রাণে লাগে। আর একজন সন্ন্যাসী প্রশ্ন করেন, আপনি আমাদের কিভাবে দেখেন? মা উত্তর দেন, নারায়ণভাবে দেখি। সেই সন্ন্যাসী বললেন, আমরা আপনার সম্ভান, নারায়ণভাবে দেখলে তো সম্ভানভাবে দেখা হয় না। মা বললেন, নারায়ণভাবেও দেখি, সন্তানভাবেও দেখি।

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

যোগীন-মার মনে একবার সন্দেহ জেগেছিল, ‘ঠাকুরকে দেখছি এমন ত্যাগী, কিন্তু মাকে দেখছি ঘোর সংসারী—–দিনরাত ভাই, ভাইপো ও ভাইঝিদের নিয়েই আছেন।' এর কিছুদিন পরে তিনি একদিন গঙ্গাতীরে বসে জপ করছেন, এমন সময় ভাবচক্ষে দেখলেন, শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সামনে এসে বলছেন, “দেখ, দেখ, গঙ্গায় কি ভেসে যাচ্ছে। যোগীন-মা দেখলেন, এক রক্তাক্ত ও নাড়ী-নাল বেষ্টিত নবজাত মৃত শিশুর দেহ ভেসে চলেছে। শ্রীরামকৃষ্ণ হেসে বললেন, ‘গঙ্গা কি কখনও অপবিত্র হয়? ওকেও (শ্রীমাকেও) তেমনি ভাববে। কখনও সন্দেহ করো না। ওকে আর একে (নিজের দেহ দেখিয়ে) অভিন্ন জানবে।'

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

সাধনজীবন সম্বন্ধে শ্রীমা ছিলেন অত্যন্ত আপোষহীন। দক্ষিণেশ্বরের দিনগুলিতে তিনি রাত তিনটের সময় উঠে জপে বসতেন। জনৈক ভক্তকে বলেছিলেন, ‘জপ-টপ কি জান? ওর দ্বারা ইন্দ্রিয়-টিন্দ্রিয়গুলোর প্রভাব কেটে যায়। আরেকদিন বলেছিলেন, 'জপধ্যান সব যথাসময়ে আলস্য ত্যাগ করে করতে হয়।’ ‘রোজ পনের, বিশ হাজার জপ করতে পার, তাহলে হয়। আগে করুক না, না হয় তখন বলবে। তবে একটু মন দিয়ে করতে হয়। তাতো নয়, কেউ করবে না, কেবল বলে–কেন হয় না??

বলতেন: 'কাজকর্ম করবে বইকি, কাজে মন ভাল থাকে। তবে জপ, ধ্যান, প্রার্থনাও বিশেষ দরকার; অন্ততঃ সকাল-সন্ধ্যায় একবার বসতেই হয়। ওটি হল যেন নৌকার হাল। সন্ধ্যাকালে একটু বসলে সমস্ত দিন ভালমন্দ কি করলাম না করলাম, তার বিচার আসে। তারপর গতকালের মনের অবস্থার সঙ্গে আজকের অবস্থার তুলনা করতে হয়, পরে জপ করতে করতে ইষ্টমূর্তির ধ্যান করতে হয়। ...কাজের সঙ্গে সকাল-সন্ধ্যা জপধ্যান না করলে কি করছ না করছ বুঝবে কি করে?”

একবার এক ভক্ত দীক্ষার পর মাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘মা উপায় কি?’ ঘরের কুলজিতে ছোট একটি ঘড়ি ছিল; মা তা দেখিয়ে বললেন, ‘ঐ ঘড়ি যেমন টিক্‌টিক্ করছে, ঠিক তেমনি নাম করে যাও, তাতেই সব হবে, আর কিছু করতে হবে না।

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

ঈশ্বরের কাছে কি করে প্রার্থনা করতে হয় শ্রীমা তাঁর নিজের কথা বলে আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। মা বলছেন, ‘আমি তখন দক্ষিণেশ্বরে রাত তিনটের সময় উঠে জপে বসতুম। কোন হুঁশ থাকত না। ...সেসব কি দিনই গিয়েছে, মা! জোছনা রাতে চাঁদের পানে তাকিয়ে জোড় হাত করে বলেছি, “তোমার ঐ জোছনার মতো আমার অন্তর নির্মল করে দাও।”” মা বলেছেন : ‘সাধন করতে করতে দেখবে আমার মাঝে যিনি, তোমার মাঝেও তিনি, দুলে বাগ্‌দি ডোমের মাঝেও তিনি–তবে তো মনে দীন ভাব আসবে।'

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) সময় অন্নবস্ত্রের কষ্ট তীব্র হয়ে উঠল। দরিদ্র মেয়েরা লজ্জা নিবারণের জন্য ন্যূনতম বস্ত্র জোটাতে পারছিল না। বস্ত্রাভাবে মেয়েরা আত্মহত্যা করছে শুনে শ্রীমা অধীরভাবে বলে উঠেছিলেন, ‘ওরা কবে যাবে গো, কবে যাবে গো।' তারপর শান্ত হয়ে বলতে লাগলেন, ‘তখন ঘরে ঘরে চরকা ছিল, ক্ষেতে কাপাস চাষ হত, সকলে সুতো কাটত, নিজেদের কাপড় নিজেরাই করিয়ে নিত, কাপড়ের অভাব ছিল না। কোম্পানি এসে সব নষ্ট করে দিলে। কোম্পানি সুখ দেখিয়ে দিলে—টাকায় চারখানা কাপড়, একখানা ফাও। সব বাবু হয়ে গেল—চরকা উঠে গেল। এখন বাবু সব কাবু হয়েছে।' কোয়ালপাড়া আশ্রমে তাঁত ও চরকার কাজ দেখে শ্রীমা বলেছিলেন, ‘আমাকেও একখানা চরকা এনে দাও, আমিও সুতো কাটি।'

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

স্বদেশী আন্দোলনের নেতা ও কর্মীরা অধিকাংশই স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। বিবেকানন্দের অবর্তমানে শ্রীমা পরোক্ষে হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের অনুপ্রেরণার উৎস। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দলে দলে তাঁরা শ্রীমাকে প্রণাম করে যেতেন। শ্রীমা তাঁদের দেখে বলেছেন, ‘ছেলেরা কী নির্ভীক! দেশের মধ্যে কী পরিবর্তন এসেছে! সকলেই বলছে তারা স্বামীজীর শিষ্য।'

বিখ্যাত বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখার্জী বা বাঘা যতীন শ্রীমায়ের কাছে নিয়মিত যাতায়াত করতেন ও আশীর্বাদ লাভ করতেন। বাঘা যতীনের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী পঞ্চানন চক্রবর্তী জানিয়েছেন : ‘পলাতক অবস্থায় মহানায়ক
যতীন্দ্রনাথ ১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দে বাগনান হইতে বালেশ্বর যাত্রাকালে স্টেশনে শুনিতে পান শ্রীমা সারদাদেবী ঐ ট্রেনে কোথাও যাইতেছেন। তিনি সকল বিপদ তুচ্ছ করিয়া মায়ের কাছে ছুটিয়া যান এবং তাঁহার আশীর্বাদ ..... লইয়া যান।’ বাঘা যতীনের মৃত্যু হয়েছিল ১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দের ১০ সেপ্টেম্বর। সম্ভবত এইটিই তাঁর সঙ্গে শ্রীমার শেষ দেখা।

১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও গান্ধীবাদী নেতা ডক্টর প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষও শ্রীমাকে দর্শন করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘আমার পরম সৌভাগ্য যে, শ্রীশ্রীমা আমার মাথায় হাত রেখে সেদিন আশীর্বাদ করেছিলেন। সেদিনের স্মৃতি আমার জীবনের অক্ষয় সম্পদ। আমি জীবনে যখনই কোন কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি বা এখনও হই, তখন সেই মুহূর্তটি আমি স্মরণ করি; আমি শ্রীশ্রীমায়ের চরণে মাথা রেখে প্রণাম করছি এবং তিনি আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করছেন।'

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

এক যুবক-ভক্তকে মা দীক্ষা দিয়ে বললেন : ঠাকুরই তোমার গুরু। যুবকটি জিজ্ঞেস করলেন : তাহলে তুমি কে? মা বললেন : আমি মা। যুবকটি মানবেন না, বললেন : তা কি করে হয়? আমার মা তো বাড়িতে আছেন, যিনি আমার গর্ভধারিণী! মা বললেন : আমিও তোমার মা। যুবকটি মানবেন না। তাঁর সোজা হিসেব— ঠাকুর ইষ্ট, সারদাদেবী গুরু আর তাঁর মা রয়েছেন তাঁর বাড়ীতে। মা জোর দিয়ে বললেন : না, আমিই তোমার সেই মা। চেয়ে দেখ ভাল করে। যুবক-ভক্তটি স্পষ্ট দেখলেন : মায়ের শ্রীমূর্তির জায়গায় তাঁরই গর্ভধারিণী।

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

সাক্ষাৎ জগজ্জননী বলে অনুভব করতেন বলে মায়ের কাছে গেলে স্বামীজী অনেক সময় বিহ্বল হয়ে পড়তেন। একদিন তিনি হরি মহারাজের (স্বামী তুরীয়ানন্দের) সঙ্গে মঠ থেকে নৌকা করে মাকে দর্শন করতে যাচ্ছেন। যেতে যেতে বার বার গঙ্গার ঘোলা জল খাচ্ছেন। হরি মহারাজ বললেন : ‘ঘোলা জল বার বার খাচ্ছ, শেষকালে কি সর্দি করে বসবে?” স্বামীজী বললেন : ‘না ভাই, ভয় করে। আমাদের তো মন—মার কাছে যাচ্ছি, ভয় করে।' ঠাকুর যাকে পবিত্রতার জ্বলন্ত বিগ্রহ বলে মনে করতেন, সেই স্বামীজীর মুখে এই কথা! এ যেন তিনি পূজা করতে যাচ্ছেন মাকে। পুজো শুরুর আগে পূজক যেমন দেহ ও অন্তর শুদ্ধ করে নেন, সেইভাবে শুদ্ধ করে নিচ্ছেন নিজেকে।

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

ভারতীয় নারীদের জাগরণের কাজে ভগিনী নিবেদিতাকে এনেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। কিন্তু সেইসময়ের রক্ষণশীল সমাজে ইউরোপীয় মহিলার প্রবেশাধিকারের ছাড়পত্র কি হবে? নিশ্চয়ই শ্রীমায়ের স্নেহ ও স্বীকৃতি। তাই স্বামীজী নিবেদিতাকে পাঠিয়েছেন শ্রীমায়ের কাছে। মা শুধু তাঁকে গ্রহণই করলেন না, তাঁদের সঙ্গে একত্রে খেলেন পর্যন্ত। মায়ের এই উদারতা দেখে স্বামীজীও বিস্ময়ে ও উল্লাসে গুরুভাই রামকৃষ্ণানন্দকে লিখেছিলেন : ‘ভাবতে পার—মা তাঁদের সঙ্গে খেলেন পর্যন্ত! দারুণ ব্যাপার নয় কি??
          নিবেদিতা তাঁকে একটা চাদর দিয়েছিলেন। জীর্ণ হয়ে গেলেও মা সেটাকে যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। বলতেন : 'কাপড়খানিকে দেখলে নিবেদিতাকে মনে পড়ে। কি মেয়েই ছিল বাবা!’ নিবেদিতা সম্বন্ধে মা বলেছিলেন : 'নিবেদিতা এখানকার, কেবল তাঁর (অর্থাৎ শ্রীরামকৃষ্ণের) ভাব ও বার্তা ওদেশে প্রচারের জন্য ওদেশে জন্মগ্রহণ করেছিল।

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

মা বলেছিলেন : 'দেখ, সব বলে কিনা আমি “রাধু-রাধু” করেই অস্থির। তার উপর আমার বড় আসক্তি। এই আসক্তিটুকু যদি না থাকত তাহলে ঠাকুরের শরীর যাবার পর এই দেহটা থাকত না।’ ‘তাঁর কাজের জন্যই না “রাধু-রাধু” করিয়ে এই শরীরটা রেখেছেন। যখন ওর উপর থেকে মন চলে যাবে তখন আর এ দেহ থাকবে না।'

১৯২০ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারির শেষে কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মা কলকাতায় এলেন। চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও রোগে ভুগে ভুগে মা ক্রমশ শীর্ণ হয়ে যেতে লাগলেন। আর দেখা গেল, রাধুর উপর থেকেও মায়ের মন ক্রমশ উঠে আসছে। নিজেই একদিন বললেন : ‘এখন মনটা সর্বদা তাঁকে চায়, অন্য কিছু আর ভাল লাগে না। এই দেখ না, রাধুকে এত ভালবাসতুম, ওর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য কত করেছি। এখন ভাব ঠিক উলটে গেছে। ও সামনে এলে ব্যাজার বোধহয়। ঠাকুর তাঁর কাজের জন্য এতকাল এইসব দিয়ে মনটাকে নামিয়ে রেখেছিলেন। নইলে তিনি যখন চলে গেলেন, তারপর কি আমার থাকা সম্ভব হত?" অবশেষে মা একদিন পরিষ্কার বললেন : ‘শরৎকে বল ওদের জয়রামবাটী পাঠিয়ে দিতে।' সেবিকা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন ওদের পাঠিয়ে দিতে বলছেন? রাধুকে ছেড়ে থাকতে পারবেন কি?? মা দৃঢ়স্বরে বললেন, 'খুব পারব, মন তুলে নিয়েছি।' সারদানন্দজী সব শুনে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বললেন : 'তবে আর মাকে রাখা গেল না। রাহুর উপর থেকে যখন মন তুলে নিয়েছেন, তখন আর আশা নেই।'

দেহত্যাগের কয়েকদিন আগে জনৈকা ভক্তমহিলাকে বললেন :

'যদি শান্তি চাও মা, কারও দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপনার করে নিতে শেখ। কেউ পর নয় মা, জগৎ তোমার। জগতের উদ্দেশ্যে এই তাঁর শেষ বাণী। আর সবাইকে জানিয়ে গেলেন আশীর্বাদ : ‘যারা এসেছে, যারা আসেনি, আর যারা আসবে, আমার সকল সন্তানদের জানিয়ে দিও মা—আমার ভালবাসা, আমার আশীর্বাদ সকলের উপর আছে।'

শেষ দিনটি : ৪ শ্রাবণ, ১৩২৭; ২১ জুলাই ১৯২০। সময় : রাত দেড়টা, মঙ্গলবার। 🍁🍂🍁🍂

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

🌺শ্রীমা সারদাদেবী সম্পর্কে মনীষী দের উক্তি-
🌸শ্রীরামকৃষ্ণ :-
বিভিন্ন সময় শ্রীরামকৃষ্ণ এই কথাগুলি বলেছেন : ‘ও সারদা—সরস্বতী— জ্ঞান দিতে এসেছে। রূপ থাকলে পাছে অশুদ্ধ মনে দেখে লোকের অকল্যাণ হয়, তাই এবার রূপ ঢেকে এসেছে।'

‘(ও) জ্ঞানদায়িনী, মহাবুদ্ধিমতী। ও কি যে সে! ও আমার শক্তি।'

🌻🌼🌻🌼🌻🌼🌻

🌸স্বামী বিবেকানন্দ:-
আমেরিকা থেকে স্বামী শিবানন্দকে (মহাপুরুষ মহারাজ' নামে যিনি পরিচিত) লেখা একটি বিখ্যাত চিঠিতে স্বামীজী মায়ের সম্বন্ধে লিখেছেন : ‘মা ঠাকরুন কি বস্তু বুঝতে পারনি, এখনও কেহই পার না, ক্রমে পারবে। শক্তি বিনা জগতের উদ্ধার হবে না। আমাদের দেশ সকলের অধম কেন, শক্তিহীন কেন?—–শক্তির অবমাননা সেখানে বলে। মা-ঠাকুরানী ভারতে পুনরায় সেই মহাশক্তি জাগাতে এসেছেন, তাঁকে অবলম্বন করে আবার সব গার্গী মৈত্রেয়ী জগতে জন্মাবে। ...এইজন্য তাঁর মঠ প্রথমে চাই। রামকৃষ্ণ পরমহংস বরং যান, আমি ভীত নই। মা-ঠাকুরানী গেলে সর্বনাশ! শক্তির কৃপা না হলে কি ঘোড়ার ডিম হবে! ...আগে মায়ের জন্য মঠ করতে হবে। আগে মা আর মায়ের মেয়েরা, তারপর বাবা আর বাপের ছেলেরা...। মায়ের কৃপা আমার উপর বাপের কৃপার চেয়ে লক্ষ গুণ বড়। ...ঐ মায়ের দিকে আমিও একটু গোঁড়া। মার হুকুম হলেই বীরভদ্র ভূতপ্রেত সব করতে পারে। ...আমেরিকা আসবার আগে মাকে আশীর্বাদ করতে চিঠি লিখেছিলুম, তিনি এক আশীর্বাদ দিলেন…...। মায়ের কথা মনে পড়লে সময় সময় বলি, “কো রামঃ?”, .... রামকৃষ্ণ পরমহংস ঈশ্বর ছিলেন কি মানুষ ছিলেন, যা হয় বলো ...কিন্তু যার মায়ের উপর ভক্তি নাই, তাকে ধিক্কার দিও।'

🌻🌼🌻🌼🌻🌼🌻

🌸ভগিনী নিবেদিতা:-
স্টেম্যান পত্রিকার সম্পাদক ও প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী মিস্টার এস. কে র‍্যাটক্লিফের স্ত্রীকে লেখা একটি পত্রে নিবেদিতা লিখেছেন : 'আমার ধারণায় (সারদাদেবী) বর্তমান পৃথিবীর মহোত্তমা নারী।

“The Master As I Saw Him' গ্রন্থে লিখেছেন : 'সারদাদেবী ভারতীয় নারীত্বের আদর্শ সম্বন্ধে শ্রীরামকৃষ্ণের চরম বাণী। কিন্তু তিনি কি প্রাচীন আদর্শের শেষ কথা, না নূতন আদর্শের প্রথম প্রকাশ?’ (অর্থাৎ তিনি উভয়ই।)

একটি চিঠিতে মাকে নিবেদিতা লিখেছেন : 'মাগো–ভালবাসায় ভরা তুমি! ...সত্যিই তুমি ঈশ্বরের অপূর্বতম সৃষ্টি। শ্রীরামকৃষ্ণের বিশ্বপ্রেম ধারণের নিজস্ব পাত্র –যে স্মৃতিচিহ্নটুকু তিনি তাঁর সন্তানদের জন্য রেখে
গেছেন। 

🌻🌼🌻🌼🌻🌼🌻

🌸মিস ম্যাকলাউড:-
[শ্রীশ্রীমায়ের দেহত্যাগের পরে] সেই নির্ভীক, শান্ত, তেজস্বী জীবনের দীপটি তাহলে নির্বাপিত হল— আধুনিক হিন্দুনারীর কাছে রেখে গেল আগামী তিন হাজার বছরে নারীকে যে মহিমময় অবস্থায় উন্নীত হতে হবে, তারই আদর্শ!

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

🌺শ্রী শ্রী মায়ের প্রতিটি কথাই অমৃততুল্য বাণী।
তৎসত্বেও তার কিছু উপদেশ ও বাণী দেওয়া হল:-

🌺 মা বলতেন :-

★🌷‘আমি সতেরও মা অসতেরও মা’, ‘সতীরও মা, অসতীরও মা।' বলতেন : ‘ভাঙতে সব্বাই পারে, গড়তে পারে কজনে? নিন্দা ঠাট্টা করতে পারে সব্বাই, কিন্তু কি করে যে তাকে ভাল করতে হবে তা বলতে পারে কজনে?’

★🌷‘সংসারে কেমন করে থাকতে হয় জান?—যখন যেমন তখন তেমন, যাকে যেমন তাকে তেমন, যেখানে যেমন সেখানে তেমন।'

★🌷‘কাজকর্ম করবে বইকি, কাজে মন ভাল থাকে। তবে জপ, ধ্যান, প্রার্থনাও বিশেষ দরকার; অন্ততঃ সকাল-সন্ধ্যায় একবার বসতেই হয়। ওটি হল যেন নৌকার হাল। সন্ধ্যাকালে একটু বসলে সমস্ত দিন ভালমন্দ কি করলাম না করলাম, তার বিচার আসে। তারপর গতকালের মনের অবস্থার সঙ্গে আজকের অবস্থার তুলনা করতে হয়, পরে জপ করতে করতে ইষ্টমূর্তির ধ্যান করতে হয়। ...কাজের সঙ্গে সকাল-সন্ধ্যা জপধ্যান না করলে কি করছ না করছ বুঝবে কি করে?”

★🌷‘আমি সত্যিকারের মা; গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, কথার কথা মা নয়—সত্য জননী।'

★🌷যদি শান্তি চাও মা, কারও দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপনার করে নিতে শেখ। কেউ পর নয় মা, জগৎ তোমার।

★🌷‘যারা এসেছে, যারা আসেনি, আর যারা আসবে, আমার সকল সন্তানদের জানিয়ে দিও মা—আমার ভালবাসা, আমার আশীর্বাদ সকলের উপর আছে।'

          –শ্রী শ্রী জগজ্জননি মা সারদা দেবী 🙏

                         🌾🍁🍂☘️🌱 

শ্রীমায়ের জন্মদিবস ও জন্মতিথি শ্রীমাকে জানাই আভূমি লুন্ঠিত সষ্টাঙ্গ শত সহস্র কোটি প্রনাম.🙏❤☘️🌼🌺

জয় মা জয় মা জয় জয় মা। 🌻🍁❤🙏🍂🌼🌸🌾🌿🌹🌿🌹🌿🌹🌿🌹🌿🌹🌿🌹🌿🌹🌿🌹🌿

মানসপুত্র নেতাজী

 🌿 মানসপুত্র নেতাজী 🍁 🌻১৯০২ সালের জানুয়ারীতে সুভাষচন্দ্রের পিতা তাঁকে কটকের মিশনারী স্কুলে ভর্তি করে দিলেন, পুত্রের প্রাথমিক বিদ্যা লাভে...