🌻🏵️কে তুমি বাজালে নবীন রাগেতে ভারতের প্রানবীণা🌻🏵️
🌼স্বামীজির শুভ জন্মদিন উপলক্ষে নিবেদনাঞ্জলি:-🌼
স্বামী বিবেকানন্দের পূর্বপুরুষদের আদি নিবাস ছিল বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার ডেরেটোনা গ্রামে। ব্রিটিশ আমলের শুরুতে তাঁরা কলকাতায় চলে আসেন—প্রথমে গড় গোবিন্দপুরে, পরে উত্তর কলকাতার সিমলায়। সিমলা-পল্লীর যে-বাড়িতে স্বামীজীর জন্ম, সেটি তৈরী করেছিলেন তাঁর প্রপিতামহ রামমোহন দত্ত। রামমোহনের জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্গাপ্রসাদ কুড়ি-বাইশ বছর বয়সে সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে যান। পুত্র বিশ্বনাথ তখন শিশু। বিশ্বনাথ নিজের চেষ্টায় বড় হয়ে ওঠেন ও এটর্নীর পেশা গ্রহণ করেন। বিবাহ হয় সিমলার নন্দলাল বসুর একমাত্র কন্যা ভুবনেশ্বরী দেবীর সঙ্গে। এঁদেরই ষষ্ঠ সন্তান নরেন্দ্রনাথ, পরবর্তিকালে স্বামী বিবেকানন্দ।
বিশ্বনাথ দত্ত অত্যন্ত উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। খাদ্য, পোশাক ও আদবকায়দায় তিনি ছিলেন হিন্দু-মুসলিম মিশ্র সংস্কৃতির অনুরাগী এবং কর্মক্ষেত্রে অনুসরণ করতেন ইংরেজদের। প্রচুর অর্থোপার্জন করতেন, কিন্তু সঞ্চয়ে আগ্রহ ছিল না। বহু আত্মীয় ও দরিদ্রকে প্রতিপালন করতেন। সাতটি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। ইতিহাস ও সঙ্গীত ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। ভুবনেশ্বরী দেবী সব অর্থেই ছিলেন তাঁর যোগ্য সহধর্মিণী। তাঁর প্রতি পদক্ষেপে প্রকাশ পেত ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্য। গরীব-দুঃখীরা কখনও তাঁর কাছ থেকে খালি হাতে ফিরত না। সংসারের সমস্ত কাজ নিজে দেখেও নিয়মিত পূজা, শাস্ত্রপাঠ ও সেলাইয়ের কাজ করতেন। প্রতিদিন প্রতিবেশীদের সুখদুঃখের খবর নিতেও ভুলতেন না। নরেন্দ্রনাথ তাঁর মায়ের কাছেই প্রথম ইংরেজি শেখেন।
১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারি (২৯ পৌষ ১২৬৯ বঙ্গাব্দ) পৌষ সংক্রান্তির দিন সকাল ৬ টা ৩৩ মিনিট ৩৩ সেকেণ্ডে নরেন্দ্রনাথের জন্ম।ভুবনেশ্বরীর বিশ্বাস, কাশীর বীরেশ্বর শিবের অনুগ্রহে এই পুত্রলাভ। তাই পুত্রের নাম রাখলেন 'বীরেশ্বর'। ‘বীরেশ্বর’ থেকে ডাকনাম দাঁড়ায় ‘বিলে'। ছোটবেলা থেকে বিলের মধ্যে দেখা যেত অসাধারণ মেধা, তেজস্বিতা, সাহস, স্বাধীন মনোভাব, হৃদয়বত্তা, বন্ধুপ্রীতি আর খেলাধূলার প্রতি আকর্ষণ। সেই সঙ্গে ছিল প্রবল আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা। ‘ধ্যান ধ্যান’ খেলতে খেলতে সত্যিই গভীর ধ্যানে ডুবে যেতেন। পুজো করতেন রাম-সীতা আর শিবের। সাধু-সন্ন্যাসী দেখলেই ছুটে যেতেন অজানা আকর্ষণে। ঘুমোনোর আগে জ্যোতিঃ দর্শন ছিল তাঁর প্রতিদিনের স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা।
বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে নরেন্দ্রনাথ হয়ে উঠলেন স্কুলের বিতর্ক ও আলোচনা সভার মধ্যমণি, খেলাধুলোতে নেতা, উচ্চাঙ্গসঙ্গীত ও ভজনে রীতিমতো প্রথম শ্রেণীর গায়ক, নাটকে কুশলী অভিনেতা, আর বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার ফলে অল্পবয়সেই গভীর চিন্তাশীল। সন্ন্যাস-জীবনের প্রতি আকর্ষণ ক্রম-বর্ধমান, কিন্তু জগতের প্রতি নিষ্ঠুর নন, গভীর মমতাশীল। মানুষের বিপদে-আপদে সর্বদা এগিয়ে যান, সে-বিপদ যেমনই হোক।
(১৮৭৯ খ্রীষ্টাব্দে মেট্রোপলিটন স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করে নরেন্দ্রনাথ প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন। কিন্তু ম্যালেরিয়ায় ভুগে ডিসকলিজিয়েট হয়ে যাওয়ায় এই কলেজ ছেড়ে তাঁকে ভর্তি হতে হয়। জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনে (বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজ)। সেখান থেকে ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে এফ. এ. এবং ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে বি. এ. পাস করেন। স্কুল-কলেজের পরীক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব না দিলেও নরেন্দ্রনাথের বিদ্যানুরাগ ছিল প্রবল এবং পড়াশুনার পরিধিও ছিল অত্যন্ত বিস্তৃত। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি দার্শনিক হার্বার্ট স্পেন্সারের একটি মতবাদের সমালোচনা করে তাঁকে চিঠি দিয়েছিলেন এবং স্পেন্সার তার উত্তরে নরেন্দ্রনাথের যথেষ্ট প্রশংসা করে লিখেছিলেন যে, বইয়ের পরবর্তী সংস্করণে তিনি সেই সমালোচনা অনুযায়ী কিছু কিছু পরিবর্তন করবেন। কলেজের অধ্যক্ষ উইলিয়াম হেস্টি পর্যন্ত তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন : ‘নরেন্দ্রনাথ সত্যিই একটি জিনিয়াস। আমি বহু জায়গায় ঘুরেছি, কিন্তু এর মতো বুদ্ধি আর বহুমুখী প্রতিভা কোথাও দেখিনি, এমনকি জার্মানীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দর্শনের ছাত্রদের মধ্যেও নয়।'
উইলিয়াম হেস্টির কাছেই নরেন্দ্রনাথ প্রথমে শুনলেন যে, দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ পরমহংসের সমাধি হয়। এরপর ১৮৮১-র নভেম্বর মাসে (সম্ভবত ৬ নভেম্বর) কলকাতায় সুরেন মিত্রর বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা। দ্বিতীয় দর্শন দক্ষিণেশ্বরে। নরেন্দ্রনাথ সেদিন সরাসরি প্রশ্ন করেন শ্রীরামকৃষ্ণকে—যে প্রশ্ন তিনি এর আগেও অনেককে করেছেন : ‘আপনি কি ঈশ্বর দর্শন করেছেন?’ উত্তর আসে : ‘হ্যাঁ, আমি তাঁকে দেখতে পাই; তোমায় যেমন দেখি, তার চেয়েও স্পষ্টভাবে তাঁকে দেখি। তুমি যদি দেখতে চাও, তোমাকেও দেখাতে পারি।” স্তম্ভিত হয়ে গেলেন নরেন্দ্রনাথ। এই প্রথম দেখলেন এমন একজন মানুষকে, যিনি ঈশ্বরকে দেখেছেন; শুধু তাই-ই নয়, অন্যকেও দেখাতে পারেন। কিন্তু সহজে তাঁকে মেনে নেননি নরেন্দ্রনাথ। বার বার পরীক্ষা করে যখন নিঃসংশয় হয়েছেন তাঁর ত্যাগ পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিকতা সম্বন্ধে, কেবল তখনই তাঁকে জীবনের ধ্রুব পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাঁর এই যাচাই করার প্রবণতা সবচেয়ে খুশী করেছে শ্রীরামকৃষ্ণকেই, যিনি কিন্তু প্রথম থেকেই বুঝেছিলেন, নরেন্দ্রনাথ নর-ঋষির অবতার, পৃথিবীতে নেমে এসেছেন মানুষের দুঃখ দূর করার জন্য, তার ভাব প্রচারের যন্ত্ররূপে।
নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের ঘনিষ্ঠ সঙ্গলাভ করেছেন প্রায় চার বছর। এই চার বছরে শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষায় এবং তাঁর নিজের যোগ্যতাগুণে নানান আধ্যাত্মিক অনুভূতি হয়েছে তাঁর। ইতিমধ্যে ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিতৃবিয়োগ হয়েছে, প্রচণ্ড আর্থিক কষ্টের মধ্যে পড়েছেন। কিন্তু বিবেক বৈরাগ্য এতটুকুও কমেনি। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণের ক্যান্সার হল। চিকিৎসার জন্য প্রথমে তাঁকে আনা হল শ্যামপুকুরে, পরে কাশীপুরের এক ভাড়াবাড়িতে। এই বাড়িতে এসে নরেন্দ্রনাথ গুরুভাইদের নিয়ে। শ্রীরামকৃষ্ণের সেবা ও তীব্র আধ্যাত্মিক তপস্যায় ডুবে গেলেন। একদিন তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে জানালেন যে, শুকদেবের মতো দিনরাত তিনি নির্বিকল্প সমাধিতে ডুবে থাকতে চান। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন : তাঁকে শুধু নিজের মুক্তি চাইলেই হবে না, তাঁকে হতে হবে বিশাল বটগাছের মতো, যার ছায়ায় এসে পৃথিবীর মানুষ শান্তিলাভ করবে। একথা বললেও তাঁর কৃপায় কাশীপুরেই নরেন্দ্রনাথ একদিন ধর্মজীবনের সর্বোচ্চ উপলব্ধি নির্বিকল্পসমাধি লাভ করলেন। সমাধি ভাঙলে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে বললেন : এই উপলব্ধির চাবি তিনি এখন নিজের কাছে রেখে দিলেন। জগতের প্রতি নরেন্দ্রনাথের কর্তব্য যখন শেষ হবে তখনই তিনি নিজের হাতে এই উপলব্ধির দ্বার আবার খুলে দেবেন।
কাশীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণ একদিন একটি কাগজে লিখে দেন : নরেন শিক্ষে দেবে।' অর্থাৎ ভারতের যে শাশ্বত আধ্যাত্মিক আদর্শ তিনি নিজের জীবনে রূপায়িত করেছেন, নরেন্দ্রনাথই তা জগতে প্রচার করবেন। নরেন্দ্রনাথ আপত্তি জানালে শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন : ‘তোর হাড় করবে।’ আর একদিন বৈষ্ণব ধর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন : “জীবে দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীবের সেবা।' নরেন্দ্রনাথ মুগ্ধ হলেন, বললেন : ‘কি অদ্ভুত আলো আজ ঠাকুরের কথায় দেখতে পেলাম।... ভগবান যদি কখনও দিন দেন তো আজ যা শুনলাম, এই অদ্ভুত সত্য সংসারের সর্বত্র প্রচার করব।' পরবর্তীকালে স্বামীজী যে মানুষের সেবার মধ্যে দিয়েই ভগবানের উপাসনার কথা এত করে বলতেন, তার উৎস হচ্ছে এই ঘটনাটি। বস্তুত, বিবেকানন্দের প্রতিটি কাজই শ্রীরামকৃষ্ণ-নির্দেশিত। শ্রীরামকৃষ্ণ সূত্র, স্বামীজী তার ভাষ্য।
সন্ন্যাসী গুরুভাইদের নিয়ে একটি সঙ্ঘপ্রতিষ্ঠার নির্দেশও শ্রীরামকৃষ্ণই। তাঁকে দিয়ে যান।(১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ আগস্ট শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগ হল। এর কিছুদিন পর নরেন্দ্রনাথ কয়েকজন গুরুভাইকে নিয়ে বরানগরের একটি পুরনো ভাঙাবাড়িতে প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠা করলেন। চরম দারিদ্র, অনশন-অর্ধাশন নিত্যসঙ্গী; তার মধ্যেও তীব্র তপস্যা, ও শাস্ত্র-আলোচনায় তাঁদের দিন কাটত (এখানে ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে নরেন্দ্রনাথ ও তাঁর দশজন গুরুভাই সন্ন্যাস নেন। নরেন্দ্রনাথের নাম ভজন কীর্তন হয় স্বামী বিবিদিষানন্দ।** সন্ন্যাসের পর স্বামীজী ও তাঁর সন্ন্যাসী গুরুভাইরা মাঝে মাঝেই পরিব্রাজক হিসেবে বেরিয়ে পড়তেন। কখনও একাকী, কখনও কয়েকজন মিলে। এইভাবে পায়ে হেঁটে স্বামীজী প্রায় সারা ভারত পরিক্রমা করেন। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-নির্ধন, রাজা-মহারাজা, ব্রাহ্মণ চণ্ডাল প্রভৃতি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁর প্রতিভা, তেজোদীপ্ত আকর্ষণীয় কান্তি এবং আধ্যাত্মিক প্রভাবে সকলেই মুগ্ধ হন। তিনিও প্রকৃত ভারতবর্ষের রূপটি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন। ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দের ৩ আগস্ট তিনি যে ভ্রমণে বের হন, সেটিই ছিল সবচেয়ে দীর্ঘকালের। এই ভ্রমণকালে তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে অনেকেই তাঁকে আমেরিকার বিশ্বধর্মমহাসভায় যোগ দিতে অনুরোধ করেন। স্বামীজী প্রথমে এ নিয়ে মাথা ঘামাননি। পরে মাদ্রাজের জনগণের ঐকান্তিক ইচ্ছায় এবং দৈবনির্দেশে (সূক্ষ্মদেহে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তাঁর চিঠির উত্তরে শ্রীমা সারদাদেবীও তাঁকে অনুমতি দিয়েছিলেন) আমেরিকায় যাওয়া স্থির করেন। স্বামীজী আমেরিকায় গিয়েছিলেন ভারতের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে তাদেরই অর্থসাহায্যে। তিনি নিজেও তা-ই চেয়েছিলেন, বলেছিলেন: 'যদি এটা মায়ের ইচ্ছা হয় যে, আমায় (আমেরিকা) যেতে হবে, তাহলে আমি সাধারণ মানুষের অর্থেই যাব। কারণ, ভারতের সাধারণ মানুষের জন্যই আমি পাশ্চাত্য দেশে যাচ্ছি— সাধারণ এবং গরীব মানুষের জন্যে।
(১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দের ৩১ মে স্বামীজী বোম্বাই থেকে জাহাজে আমেরিকা যাত্রা করলেন। ভ্যাঙ্কুবরে পৌঁছলেন ২৫ জুলাই। সেখান থেকে ট্রেনে করে ৩০ জুলাই সন্ধ্যায় শিকাগো পৌঁছলেন। ধর্মমহাসভার দেরি আছে জেনে কম খরচে থাকবার জন্য স্বামীজী বস্টনে চলে যান। বস্টনে তিনি বিভিন্ন পণ্ডিত ও অধ্যাপকের সংস্পর্শে আসেন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাইট। স্বামীজীর নামে কোন পরিচয়পত্র নেই জেনে অধ্যাপক রাইট ধর্মমহাসভা কমিটির চেয়ারম্যান ডঃ ব্যারোজকে এক চিঠিতে লেখেন : 'আমাদের সব অধ্যাপককে সম্মিলিত করলে যা হবে, এই সন্ন্যাসী তার চেয়েও বেশি পণ্ডিত।"
১১ সেপ্টেম্বর ধর্মমহাসভা শুরু হল। স্বামীজী বক্তৃতা দিলেন বিকেলে। ‘আমেরিকার বোন ও ভায়েরা? এই সম্বোধন করার সঙ্গে সঙ্গে সভার সাত হাজার শ্রোতা তাঁকে বিপুল অভিনন্দন জানাল। এর পর স্বামীজী একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। তাতে সব ধর্মের প্রতি তাঁর উদার প্রীতিপূর্ণ মনোভাবের অপূর্ব প্রকাশ দেখে শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে গেল। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন স্বামীজী। ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্মমহাসভা চলল। তাঁকে প্রায় প্রতিদিনই বক্তৃতা করতে হল। তাঁর উদার যুক্তিমূলক চিন্তার জন্য সকলেই তাঁকে ধর্মমহাসভার শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবে স্বীকার করে নিল। শিকাগোর রাস্তায় রাস্তায় শোভা পেতে থাকে তাঁর ছবি। খবরের কাগজগুলি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল এই ধরনের অজস্র প্রশংসায় :
‘ধর্মমহাসভায় বিবেকানন্দ অবিসংবাদিতভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তাঁর বক্তৃতা শুনে আমরা বুঝছি যে, এই শিক্ষিত জাতির মধ্যে ধর্মপ্রচারক পাঠানো কতটা নির্বুদ্ধিতার কাজ।' — (দি হেরাল্ড) ‘স্বীয় ভাবরাশির চমৎকারিত্ব ও আকৃতির প্রভাবে তিনি মহাসভায় অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিবেকানন্দ শুধু মঞ্চের একদিক থেকে আর একদিকে হেঁটে গেলেই হাততালি পেয়ে থাকেন, আর হাজার মানুষের এই সুস্পষ্ট প্রশংসায় তিনি বিন্দুমাত্র গর্ব প্রকাশ করেন না। শিশুসুলভ সারল্যে তা গ্রহণ করেন।' –(দি বস্টন ইভনিং ট্রান্সক্রিপ্ট) ‘অনুষ্ঠান-সূচীতে সব শেষে ছাড়া বিবেকানন্দকে বক্তৃতা দিতে দেওয়া হত না। এর উদ্দেশ্য ছিল শ্রোতাদের শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা। কোন গরম দিনে নীরস বক্তার সুদীর্ঘ বক্তৃতার ফলে যখন শত শত লোক সভাগৃহ ত্যাগ করতে থাকত, তখন বিরাট শ্রোতৃমণ্ডলীকে ধরে রাখার জন্য শুধু এইটুকু ঘোষণা করলেই যথেষ্ট হত যে, শেষ প্রার্থনার আগে বিবেকানন্দ কিছু বলবেন। অমনি তাঁর পনেরো মিনিটের বক্তৃতা শোনার জন্য। শ্রোতারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত।'—(নরদ্যাম্পটন ডেলি হেরাল্ড, ১১ এপ্রিল ১৮৯৪)
এর পর স্বামীজী আমেরিকার বড় বড় শহরে ধর্মপ্রচার করতে থাকেন। আমেরিকার জনসাধারণ, বিশেষ করে শিক্ষিত সম্প্রদায়, আরও বেশি। করে তাঁর অনুরাগী হয়ে ওঠে। শুধু সঙ্কীর্ণমনা কয়েকজন ভারতীয় ও খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের কিছু লোক ঈর্ষাপরবশ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা বিষোদ্গার করতে থাকে। সাময়িকভাবে বিপন্ন হলেও স্বামীজী নিজের চরিত্র-মাহাত্ম্যে সব ঝড়-ঝাপটা কাটিয়ে ওঠেন। দু-বছর পর ১৮৯৫-র আগস্ট মাসে তিনি ইউরোপে যান। প্যারিস ও লণ্ডনে প্রচার করে ডিসেম্বর মাসে আবার আমেরিকায় ফিরে আসেন। ১৮৯৬-র ১৫ এপ্রিল আমেরিকা থেকে বিদায় নিয়ে আবার লণ্ডনে আসেন। ইংল্যাণ্ডে স্বামীজীর প্রভাব সম্পর্কে বিপিনচন্দ্র পাল একটি চিঠিতে লিখেছেন : 'ইংল্যাণ্ডের অনেক জায়গায় আমি এমন বহু লোকের সান্নিধ্যে এসেছি যাঁরা স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তি পোষণ করেন। সত্য বটে, আমি তাঁর সম্প্রদায়ভুক্ত নই এবং তাঁর সঙ্গে কোন কোন বিষয়ে আমার মতভেদ আছে, তথাপি আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, বিবেকানন্দের প্রভাবগুণে এখানে (ইংল্যাণ্ডে) অনেকের চোখ খুলেছে...। তাঁর শিক্ষার ফলেই এখানকার অধিকাংশ লোক আজকাল বিশ্বাস করে যে, প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রগুলির মধ্যে বিস্ময়কর আধ্যাত্মিক তত্ত্ব নিহিত আছে।' লণ্ডন থেকে স্বামীজী ভারতের পথে রওনা হন ১৮৯৬-র ১৬ ডিসেম্বর এবং ১৮৯৭-র ১৫ জানুয়ারি কলম্বোয় এসে পৌঁছন।
পাশ্চাত্যে তাঁর অভাবনীয় সাফল্য তাঁর দেশবাসীদের মনে যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা জাগিয়ে তুলেছিল, তাতে তাদের বহুযুগ-সঞ্চিত হীনম্মন্যতা নিমেষে দূর হয়ে গেছিল। ভারতবাসী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করেছিল : বিশ্বের সভ্যতা ভাণ্ডারে তাদের অবদান পাশ্চাত্যের চেয়ে কম নয়, বরং বেশীই। এই উপলব্ধি যে এনে দিল, সমগ্র দেশের তমোনিদ্রা যে ভেঙে দিল, সেই জাদুকরের মতো মানুষটিকে বরণ করার জন্য গোটা দেশই তখন অধীর আগ্রহে কম্পমান। তাই স্বামীজী যখন। কলম্বোয় এসে পৌঁছলেন, দেখলেন, গোটা দেশের কৃতজ্ঞতা এক অভূতপর্ব অভিনন্দনের রূপ নিয়েছে। সেই অভিনন্দনের ঢেউ তরঙ্গায়িত হয়ে বয়ে চলল রামনাদ, মাদ্রাজ, মাদ্রাজ থেকে কলকাতার পথে সর্বত্র। ১৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতা পৌঁছলেন স্বামীজী। অভিনন্দনের পর অভিনন্দন–কলকাতা মাতাল তার বিশ্ববিজয়ী ছেলেকে নিয়ে।
পাশ্চাত্যে অবিরাম বক্তৃতা আর ভ্রমণ, তার উপর সমগ্র জাতির এই ‘স্নেহের অত্যাচার’—এসবের ফলে স্বামীজীর শরীর এবার ভেঙে পড়ল। কিন্তু তারই মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ উপদিষ্ট পথে সন্ন্যাসিসঙ্ঘকে স্থায়ী ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন। স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে মাদ্রাজে পাঠালেন শাখাকেন্দ্র গড়ে তুলতে। মুর্শিদাবাদের সারগাছিতে স্থায়ী সেবাশ্রম গড়ে তুললেন স্বামী অখণ্ডানন্দ। অন্যান্য সন্ন্যাসী ভাইদেরও নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিলেন। স্বামী সারদানন্দ ও স্বামী অভেদানন্দের উপর যথাক্রমে আমেরিকা ও ইংল্যাণ্ডের কার্যভার দিলেন। ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দের ১ মে স্বামীজী রামকৃষ্ণ মিশনের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা করলেন। বিদেশ থেকেই তাঁর চিন্তা ছিল ভাবী সঙ্ঘের জন্য গঙ্গাতীরে একটা স্থায়ী জমি কেনা। সেই স্বপ্ন সফল হল ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দে। ঐ বছরের ৯ ডিসেম্বর বেলুড়ে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ স্থাপিত হল।
১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ২০ জুন স্বামীজী দ্বিতীয়বারের জন্য পাশ্চাত্য যাত্রা করলেন এবং দু-সপ্তাহ ইংল্যাণ্ডে থেকে আগস্ট মাসে আমেরিকা পৌঁছলেন। আমেরিকায় এবার প্রায় এক বছর ছিলেন এবং নববইটিরও বেশী বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তবে তাঁর এবারকার পাশ্চাত্যভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল ঐ সব দেশে তাঁর প্রতিষ্ঠিত কাজকর্ম কিরকম চলছে তা দেখা এবং তার ভিত্তি সুদৃঢ় করা। প্যারিস, ভিয়েনা, কনস্টানটিনোপল, এথেন্স ও মিশর হয়ে স্বামীজী ৯ ডিসেম্বর (১৯০০) বেলুড় মঠে পৌঁছলেন।
দেশে ফিরেই ২৭ ডিসেম্বর স্বামীজী মায়াবতী রওনা হন। সেখান থেকে ফেরেন ২৪ জানুয়ারি (১৯০১)। ৬ ফেব্রুয়ারি মঠের ট্রাস্ট ডীড রেজিষ্ট্রী হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি মঠের ট্রাস্টীদের অনুমোদনক্রমে স্বামী ব্রহ্মানন্দ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ এবং স্বামী সারদানন্দ সম্পাদক হন। এইভাবে নিজেকে
সঙ্ঘের সমস্ত কার্য পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নিয়ে শেষ দু-বছর স্বামীজী মহাসমাধির জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। গুরুভাই কিংবা শিষ্যরা কোন পরামর্শ চাইলেও দিতে চাইতেন না। তাঁদের নিজেদের বুদ্ধিমতো কাজ করতে বলতেন, যাতে তাঁর অবর্তমানে তাঁরা সঙ্ঘের পরিচালনা ব্যাপারে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
( স্বামীজী মরদেহ ত্যাগ করেন ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দের ৪ জুলাই। সন্ধ্যাবেলা বেলুড় মঠে নিজের ঘরে ধ্যান করছিলেন। রাত ৯টা ১০ মিনিটে সেই ধ্যানই মহাসমাধিতে পরিণত হয়। তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৯ বছর ৫ মাস ২৪ দিন। কিন্তু স্থূলদেহের নাশ হলেও যে-শক্তি বিবেকানন্দ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল, সূক্ষ্মভাবে তা কাজ করে চলেছে এখনও। পৃথিবীর মানুষের কাছে স্বামীজী নিজেই দিয়ে গেছেন সেই প্রতিশ্রুতি : ‘এমনও হতে পারে যে, এই শরীরটাকে পুরনো কাপড়ের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এর বাইরে চলে যাওয়াই আমি শ্রেয় মনে করব। কিন্তু কখনও আমি কাজ থেকে বিরত হব না। সর্বত্র আমি মানুষকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাব, যতদিন না প্রতিটি মানুষ বুঝতে শেখে যে সে ভগবান।'
ভারতবর্ষের নবজাগরণের প্রতিটি ক্ষেত্রকে স্বামীজী বিরাটভাবে প্রভাবিত করেছেন। সমগ্র পৃথিবীর জন্যও রেখে গেছেন অমূল্য পথনির্দেশ। অনেক মনীষীই তাঁকে আধুনিক ভারতের স্রষ্টা বলে মনে করেন। এ প্রসঙ্গে চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীর উক্তি স্মরণীয় : “আমাদের আধুনিক ইতিহাসের দিকে তাকালে যে কেউ স্পষ্ট দেখতে পাবেন—স্বামী বিবেকানন্দের কাছে আমরা কত ঋণী। ভারতের আত্মমহিমার দিকে ভারতের নয়ন তিনি উন্মীলিত করে দিয়েছিলেন। তিনি রাজনীতির আধ্যাত্মিক ভিত্তি নির্মাণ করেছিলেন। আমরা অন্ধ ছিলাম, তিনি আমাদের দৃষ্টি দিয়েছেন। তিনিই ভারতীয় স্বাধীনতার জনক—আমাদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার তিনি পিতা।")
((** আত্মগোপন করার জন্য স্বামীজী নানা নাম নিয়ে চলতেন : বিবিদিষানন্দ, সচ্চিদানন্দ, বিবেকানন্দ। শিকাগো মহাসভায় ‘বিবেকানন্দ' নামেই আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে সেই নামেই জগৎ তাঁকে চেনে।**))
********
স্বামীজির জীবনে অসংখ্য জানা অজানা ঘটনা রয়েছে, তাহার জীবনী আসমুদ্রহিমাচলসম বললেও কম বলা হবে, এই মহাপুরুষের জীবনের সব ঘটনা, বাণী, কর্ম ব্যক্ত করা সম্ভব নয় এতদসত্বেও সেই পুরুষ সিংহ স্বামীজির মহান ও সুবিশাল কর্মজীবন থেকে কিছু কিছু ঘটনা ও তথ্য উপস্থাপন করা হলো:-
*******
নরেন্দ্রনাথের মা ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন একজন মহীয়সী নারী। স্বামী বিবেকানন্দ পরবর্তিকালে বহুবার বলেছেন : ‘আমার জ্ঞানের বিকাশের জন্য আমি মার কাছে ঋণী।' তাঁর শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি ছিল অদ্ভুত। একটি ঘটনা থেকে তা বোঝা যাবে। স্কুলে একদিন বিনাদোষে নরেন্দ্রকে শাস্তি পেতে হয়। ভূগোলের ক্লাসে নরেন্দ্রনাথ সঠিক উত্তরই দিয়েছিলেন, কিন্তু মাস্টারমশায়ের মনে হল তাঁর উত্তর ভুল। তাই তিনি নরেন্দ্রকে শাস্তি দিলেন। নরেন্দ্র বারবার প্রতিবাদ করলেন : “আমার ভুল হয়নি, আমি ঠিকই বলেছি।' কিন্তু এতে মাস্টারমশায় আরও রেগে গেলেন, বেত দিয়ে নির্দয়ভাবে নরেন্দ্রকে মারতে লাগলেন। বাড়ি ফিরে গিয়ে নরেন্দ্রনাথ কাঁদতে কাঁদতে সব কথা মাকে বললেন। মা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন : 'বাছা, তোমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, তবে এতে কি এসে যায়? ফল যাই হোক না কেন, সর্বদা যা সত্য বলে মনে করবে তাই করে যাবে।’ মায়ের এই উপদেশের পরিপূর্ণ রূপ নরেন্দ্রনাথ দেখেছিলেন গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, আচরণেও দেখাতেন : ‘সত্যই কলির তপস্যা।" মা এবং গুরুদেব উভয়ের মধ্যেই যে সত্যনিষ্ঠার আদর্শ দেখেছিলেন, তা স্বীয় জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে রূপায়িত করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। পরবর্তিকালে তাই বিবেকানন্দের কাছ থেকে জগৎ শুনেছে মহাবলিষ্ঠ এই বাণী :("সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোন কিছুর জন্যই সত্যকে ত্যাগ করা যায় না।
*******
নরেন্দ্রনাথের বাবা বিশ্বনাথ দত্ত মুক্তহস্তে দান করতেন। তাঁর মধ্যম পুত্র মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন : ‘গরীব-দুঃখীকে দান করা তাঁহার যেন একটা ব্যামোর মতো ছিল।' পাড়ায় তাঁর নাম হয়েছিল দাতা বিশ্বনাথ। কারও অর্থকষ্ট দেখলে তিনি নিজেকে সামলাতে পারতেন না। দূরসম্পর্কের অনেক ছাত্র তাঁর বাড়িতে থেকে তাঁরই খরচে পড়াশুনা করত। পাড়া-প্রতিবেশী কেউ অভাবে পড়লে তিনি জানতে পারলেই তাকে সাহায্য করতেন। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ বেহিসেবী। তাঁর এই নির্বিচার দানের সুযোগে অনেক নেশাখোর এসে তাঁর কাছ থেকে টাকা নিয়ে নেশা করে বেড়াত। একদিন নরেন্দ্রনাথ বিশ্বনাথবাবুর দানের এইরকম অপব্যবহারের কথা তাঁর কানে তুললে বিশ্বনাথবাবু তাঁকে বলেছিলেন : ‘জীবনটা যে কত দুঃখের তা তুই এখন কি বুঝবি? যখন বুঝতে পারবি, তখন এ দুঃখের হাত থেকে ক্ষণিক নিস্তার লাভের জন্য যারা নেশাভাঙ করে তাদের পর্যন্ত দয়ার চোখে
দেখবি।' বাবার এই উপদেশের পূর্ণতর রূপ নরেন্দ্রনাথ দেখেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ও বাণীর মধ্যে। ‘দয়ার দৃষ্টি’ ‘শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে’ পরিণত হয়েছিল। কারণ, শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে শিখিয়েছিলেন : দয়াও ছোট কথা। মানুষ ঈশ্বরের জীবন্ত রূপ। ঈশ্বরকে কি আমরা দয়া করবার কথা ভাবি? ঈশ্বরের সেবা করে, পূজা করে আমরা ধন্য হই। তাই দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীবসেবা। মানুষকে ভগবান ভেবে সেবা। কোন মানুষই ঘৃণ্য নয়। যে পাপী সেও আসলে ভগবান। ‘চোররূপী নারায়ণ, লুচ্চারূপী নারায়ণ।' পরবর্তিকালে স্বামী বিবেকানন্দ তাই জগতের প্রতিটি মানুষকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন—যে অধঃপতিত তাকেও। বলতেন: 'God the wicked', 'God the sinner দুর্জন, পাপী সকলেই ভগবান। আর বলতেন : ‘যদি একজনের মনে—এ সংসার-নরককুণ্ডের মধ্যে একদিনও একটু আনন্দ ও শান্তি দেওয়া যায়, সেইটুকুই সত্য, এই তো আজন্ম ভুগে দেখছি।"
******
নরেন্দ্র খুব সুন্দর গল্প করতে পারতেন। তাঁর কথা এবং ব্যক্তিত্বের এমন আকর্ষণ ছিল যে, তিনি গল্প আরম্ভ করলে সবাই সব কাজ ভুলে তাঁর কথাই শুনত। স্কুলে ক্লাসের ফাঁকে একদিন তিনি গল্প করছেন। গল্প এত জমে গেছে যে, শিক্ষক এসে পড়াতে শুরু করলেও সকলে পড়ার দিকে মন না দিয়ে তাঁর কথাই শুনছে। কিছুক্ষণ পরে শিক্ষক ফিসফিস শব্দ শুনে ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। বিরক্ত হয়ে তিনি এক এক করে সবাইকে পরীক্ষা করলেন তিনি যা পড়াচ্ছিলেন তারা তা শুনেছে কিনা। কেউ উত্তর দিতে পারল না। কিন্তু নরেন্দ্রর মন ছিল দু-মুখো, গল্পের ফাঁকেও তিনি মনের একটা অংশ পড়ার দিকে রেখে দিতেন। তাই শিক্ষক যখন নরেন্দ্রনাথকে পড়া জিজ্ঞাসা করলেন, নরেন্দ্র নির্ভুল উত্তর দিলেন। শিক্ষক তখন জিজ্ঞেস করলেন : এতক্ষণ কে কথা বলছিল? সকলে নরেন্দ্রকে দেখিয়ে দিল। শিক্ষকের তা বিশ্বাস হল না। তিনি নরেন্দ্র ছাড়া আর সবাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। সকলের সঙ্গে নরেন্দ্র উঠে দাঁড়ালেন। শিক্ষক
বললেন: 'তোমাকে দাঁড়াতে হবে না।' নরেন্দ্র বললেন : ‘না, আমাকেও দাঁড়াতে হবে, কারণ আমিই তো কথা বলছিলাম।' তিনি দাঁড়িয়েই রইলেন।
********
স্বামীজির পরিব্রাজক জীবনের ঘটনা:-
স্বামীজীকে একবার একজন বলেছিলেন : সন্ন্যাসীর পক্ষে নিজের দেশের মায়া ত্যাগ করে সব দেশকে একই রকম দৃষ্টিতে দেখা উচিত। স্বামীজী উত্তর দিয়েছিলেন : ‘যে আপনার মাকে ভাত দেয় না, সে অন্যের মাকে কি পুষবে?’ অর্থাৎ সন্ন্যাসীরও উচিত মাতৃভূমিকে ভালবাসা। নিজের দেশকেই যে ভালবাসতে পারে না, সে গোটা পৃথিবীকে আপন করে নেবে কি করে? প্রথমে স্বদেশপ্রেম, স্বদেশপ্রেমের সিঁড়ি বেয়ে বিশ্বপ্রেম।
হিমালয়ের চড়াই-উতরাই বেয়ে চলেছেন স্বামীজী। এক চড়াইয়ের সামনে স্বামীজী দেখলেন, একটি বৃদ্ধ ক্লান্ত অবসন্ন হতাশ ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। স্বামীজীকে দেখে বৃদ্ধ বললেন : ‘মহারাজ, এত পথ যাব কি করে? আমি তো আর চলতেই পারছি না- আমার ছাতি ফেটে যাবে।' স্বামীজী তাঁকে বললেন: 'নিজের পায়ের দিকে তাকান তো। পেছনে আপনার পায়ের তলায় যে পথ পড়ে আছে, আপনি তা মাড়িয়ে এসেছেন, আর সামনে যে পথ দেখছেন, তাও তো সেই একই পথ—ও পথটুকুও শিগ্গিরই আপনি পা দিয়ে মাড়িয়ে যাবেন।' স্বামীজীর কথায় বৃদ্ধের নৈরাশ্য কেটে গেল—তিনি আবার পথ চলতে লাগলেন।
******
স্বামীজী তখন কাশীতে আছেন। খবর পেলেন গুরুভাই বলরামবাবু দেহত্যাগ করেছেন। এই দুঃসংবাদ শুনে স্বামীজী অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না। স্বামীজীকে শোক করতে দেখে কাশীর পণ্ডিত প্রমদাদাস মিত্র বললেন : 'আপনি সন্ন্যাসী হয়েও এত শোকাকুল কেন? সন্ন্যাসীর পক্ষে শোক প্রকাশ করা অনুচিত।' স্বামীজী উত্তর দিলেন : ‘বলেন কি? সন্ন্যাসী হয়েছি বলে হৃদয়টা বিসর্জন দেব? প্রকৃত সন্ন্যাসীর হৃদয় সাধারণ লোকের হৃদয়ের চেয়ে বরং আরও বেশী কোমল হওয়া উচিত। হাজার হোক, আমরা মানুষ তো বটে। আর তাছাড়া তিনি যে আমার গুরুভাই ছিলেন। যে-সন্ন্যাসে হৃদয় পাষাণ করতে শিক্ষা দেয়, আমি সে সন্ন্যাস গ্রাহ্য করি না।"
স্বামীজী বলতেনঃ যে-সন্ন্যাসীর মনে অপরের কল্যাণ করার ইচ্ছা নেই, সে সন্ন্যাসীই নয়।
বলতেন : ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায় সন্ন্যাসীর জন্ম।... পরের জন্য প্রাণ দিতে, জীবের গগনভেদী ক্রন্দন নিবারণ করতে, বিধবার অশ্রু মুছাতে, পুত্র-বিয়োগ-বিধুরার প্রাণে শান্তিদান করতে, অজ্ঞ ইতরসাধারণকে জীবন সংগ্রামের উপযোগী করতে... সকলের ঐহিক ও পারমার্থিক মঙ্গল করতে এবং জ্ঞানালোক দিয়ে সকলের মধ্যে প্রসুপ্ত ব্রহ্মসিংহকে জাগরিত করতে জগতে সন্ন্যাসীর জন্ম হয়েছে।'
*******
পরিব্রাজক-জীবনের আর একটি ঘটনা। মীরাটে এসে স্বামীজীর দেখা হয়ে গেল আরও কয়েকজন গুরুভাইয়ের সঙ্গে। তারাও সন্ন্যাস গ্রহণ করে পরিব্রাজক বেশে ঘুরছিলেন। সকলে মিলে এক জায়গায় উঠলেন। স্বামীজীর খুব পড়াশুনার অভ্যাস। এক গুরুভাই প্রতিদিন স্থানীয় এক লাইব্রেরী থেকে তাঁর জন্য বই নিয়ে আসেন। মোটা মোটা বই। কিন্তু স্বামীজীর তা একদিনেই পড়া হয়ে যায়। তাই পরদিনই সেই বই ফেরত দিয়ে নতুন বই আনতে হয়। লাইব্রেরিয়ান এতে ভাবলেন, স্বামীজী লোককে দেখানোর জন্য পড়ার ভান করছেন শুধু। স্বামীজীর গুরুভাইয়ের কাছে তিনি এই সন্দেহের ইঙ্গিতও দিলেন। স্বামীজী একথা জেনে একদিন নিজে সেই লাইব্রেরিয়ানের কাছে হাজির হলেন এবং বললেন : ‘আমি সব কটা বই-ই ভাল করে পড়েছি। আপনার সন্দেহ হলে আপনি যে-কোন বই থেকে যে-কোন প্রশ্ন করে দেখতে পারেন।' লাইব্রেরিয়ান তাই করলেন। স্বামীজী সব প্রশ্নের উপযুক্ত উত্তর দিলেন দেখে লাইব্রেরিয়ানের বিস্ময়ের সীমা রইল না। তিনি ভাবতে লাগলেন, এ-ও কি সম্ভব?
খেতড়ির রাজার সঙ্গে পরিচয় হবার পরে স্বামীজী যখন তাঁর অতিথি হয়েছিলেন তখন রাজা লক্ষ্য করেছিলেন, স্বামীজী পড়বার সময় বইয়ের দিকে তাকিয়ে খুব তাড়াতাড়ি পৃষ্ঠাগুলো শুধু উলটে যান আর তাতেই তাঁর গোটা বইটা পড়া হয়ে যায়।
স্বামীজীকে জিজ্ঞাসা করলেন—–কি করে এটা সম্ভব? স্বামীজী বুঝিয়ে বললেন : ছোট ছেলে যখন প্রথম পড়তে শেখে তখন সে একটা একটা অক্ষর দু-তিনবার উচ্চারণ করে তবে শব্দটি পড়তে পারে। তখন তার নজর থাকে এক-একটা অক্ষরের উপরে। আরও কিছুদিন শেখার পরে সে আর অক্ষর ধরে পড়ে না—তার নজর তখন থাকে এক-একটা শব্দের দিকে। আরও অভ্যাসের পরে সে একনজরে এক-একটা বাক্য ধরে পড়তে পারে। এমনিভাবে ক্রমশ ভাবগ্রহণের ক্ষমতা বাড়িয়ে গেলে, একনজরে একটা পৃষ্ঠা পড়ে ফেলা যায়। তিনি সেইভাবেই পড়েন। স্বামীজী আরও বললেন: এ শুধু অভ্যাস, ব্রহ্মচর্য ও একাগ্রতার ফল—যে-কেউ চেষ্টা করলেই তা করতে পারে।
বেলগাঁওর হরিপদ মিত্রকে একবার তিনি চার্লস ডিকেন্সের ‘পিকউইক পেপার্স’ থেকে অনর্গল মুখস্থ বলে অবাক করে দিয়েছিলেন। হরিপদ মিত্র আরও অবাক হয়েছিলেন যখন শুনেছিলেন—স্বামীজী ঐ বইটা মাত্র দুবার পড়েই এরকম মুখস্থ করে ফেলেছেন। স্বামীজী হরিপদ মিত্রকে বললেন : একাগ্রতা ও ব্রহ্মচর্যের ফলে এরকম স্মৃতিশক্তি হওয়া সম্ভব।
স্বামীজীর বিদেশ থেকে ফিরে আসবার পরের ঘটনা। মঠে নতুন এক সেট এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা আনা হয়েছে। স্বামীজীর ঘরে সেগুলি রেখে দেওয়া হয়েছে। শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী সেগুলি দেখে মন্তব্য করেন : ‘এত বই একজীবনে পড়া দুর্ঘট।' স্বামীজী শুনে বললেন : ‘কি বলছিস? এই দশখানা বই থেকে আমায় যা ইচ্ছা জিজ্ঞেস কর— সব বলে দেব।' শিষ্য জানতেন না যে, স্বামীজী ইতিমধ্যেই দশ খণ্ড বই পড়ে ফেলেছেন এবং এখন একাদশ খণ্ডটি পড়ছেন। স্বামীজীর কথামতো পরীক্ষা করে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। স্বামীজী শুধু তাঁর সব প্রশ্নের উত্তরই দিলেন না, অনেক ক্ষেত্রে এনসাইক্লোপিডিয়ার ভাষা পর্যন্ত হুবহু মুখস্থ বলে গেলেন। শিষ্যকে স্বামীজী বললেন : 'দেখলি, একমাত্র ব্রহ্মচর্যপালন ঠিক ঠিক করতে পারলে সমস্ত বিদ্যা মুহূর্তে আয়ত্ত হয়ে যায়—শ্রুতিধর, স্মৃতিধর হয়।'
বিদেশে একবার দর্শনের অধ্যাপক পল ডয়সন স্বামীজীর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি দেখে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন। স্বামীজী ডয়সনকে বলেছিলেন : তাঁর স্মৃতিশক্তির রহস্য মনঃসংযম ও একাগ্রতা।
*********
রাজপুতানা। পরিব্রাজক স্বামীজী আবু-পাহাড়ে এক মুসলমান উকিলের বাড়িতে এসে উঠেছেন। একদিন খেতড়ি-রাজের প্রাইভেট সেক্রেটারি জগমোহনলাল ঐ উকিলের বাড়িতে এসে স্বামীজীকে দেখলেন। স্বামীজীকে তিনি প্রশ্ন করলেন : ‘আপনি তো হিন্দু সাধু; আপনি মুসলমানের বাড়িতে আছেন কি করে?? জাত-পাত-ধর্মীয় ভেদাভেদের ইঙ্গিতমাত্রও স্বামীজীর কাছে অসহ্য ছিল। তিনি গর্জে উঠলেন: “আপনি বলছেন কি? আমি তো সন্ন্যাসী। আমি আপনাদের সমস্ত সামাজিক বিধিনিষেধের উর্ধে। আমি ভাঙ্গীর (মেথরের) সঙ্গে পর্যন্ত খেতে পারি। ভগবান অপরাধ নেবেন, সে ভয় আমার নেই, কেননা এটা ভাবানের অনুমোদিত। শাস্ত্রের দিক থেকেও আমার ভয় নেই, কেননা শাস্ত্রে এটা অনুমোদিত। তবে আপনাদের এবং আপনাদের সমাজের ভয় আছে বটে! আপনারা তো আর ভগবান বা শাস্ত্রের ধার ধারেন না। আমি দেখি বিশ্বপ্রপঞ্চের সর্বত্র ব্রহ্ম প্রকাশিত আছেন। আমার দৃষ্টিতে উঁচু-নীচু নেই। শিব, শিব ! স্বামীজীর কথায় ও ভঙ্গিতে যেন বিদ্যুৎ বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। জগমোহনলাল মুগ্ধ হলেন।
*******
রাজস্থানের এক রেলস্টেশনে আছেন স্বামীজী। সারাদিন তাঁর কাছে লোক আসছে। নানা প্রশ্ন তাদের। স্বামীজী সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। লোক আসার শেষ নেই, স্বামীজীরও ধর্মপ্রসঙ্গের বিরাম নেই। এত লোক আসছে— কেউ কিন্তু একবারও খোঁজ করছে না স্বামীজীর খাওয়া হয়েছে কিনা। এইভাবে পর পর তিনদিন সম্পূর্ণ অনাহারে থেকে স্বামীজী ধর্ম-প্রসঙ্গ করে চলেছেন। জল পর্যন্ত খেতে পারেননি। তৃতীয়দিন রাত্রে সবাই চলে যাবার পর একটি গরীব লোক এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, 'মহারাজ, আপনি তিনদিন তো অনবরত কথাই বলেছেন, জল পর্যন্ত খাননি। এতে আমার প্রাণে বড় ব্যথা লেগেছে।' স্বামীজীর মনে হল স্বয়ং ভগবানই দীনবেশে এসেছেন। তিনি বললেন : ‘তুমি আমায় কিছু খেতে দেবে?? লোকটি জাতিতে চামার, সে বলল : 'আমার প্রাণ তো তাই চায়; কিন্তু আমার তৈরী রুটি আপনাকে দেব কি করে? আজ্ঞা হয় তো আমি আটা ডাল এনে দিই, আপনি ডাল-রুটি বানিয়ে নিন। স্বামীজী বললেন: 'না, তোমার তৈরী রুটিই আমায় দাও; আমি তা-ই খাব।' লোকটি শুনে ভয় পেল—রাজা যদি জানতে পারে যে সে চামার হয়েও সন্ন্যাসীকে রুটি তৈরী করে দিয়েছে তবে হয়তো তাকে শাস্তি পেতে হবে। তবুও সাধুসেবার প্রবল আগ্রহে নিজের বিপদ তুচ্ছ করেও স্বামীজীর জন্য রুটি তৈরী করে নিয়ে এল। তার দয়া দেখে স্বামীজীর চোখে জল এল, ভাবলেন : আমাদের দেশের কুঁড়েঘরে এরকম কত মানুষ বাস করে, যারা বাইরে দীন-দরিদ্র-অন্ত্যজ কিন্তু অন্তরে মহান। এদিকে স্টেশনের কয়েকজন ভদ্রলোকের নজরে পড়ল স্বামীজী চামারের হাত থেকে খাবার নিয়ে খাচ্ছেন। খাচ্ছেন। তারা এসে তাঁকে বলল: 'আপনি যে নীচ ব্যক্তির ছোঁয়া খাবার খেলেন এটা কি ভাল হল ?? স্বামীজী উত্তর দিলেন : 'তোমরা তো এতগুলো লোক আমাকে তিনদিন ধরে বকালে, কিন্তু আমি কিছু খেলাম কিনা তার কি খোঁজ নিয়েছিলে? অথচ এ ছোটলোক হল, আর নিজেরা ভদ্র বলে বড়াই করছ? ও যে মনুষ্যত্ব দেখিয়েছে, তাতে ও নীচ হল কি করে?’
*****
স্বামীজী নিজেকে শ্রদ্ধা করতেন, শ্রদ্ধা করতেন নিজের দেশ ও জাতিকে। সঙ্গে সঙ্গে চাইতেন ভারতবর্ষের প্রতিটি মানুষই আত্মমর্যাদাবোধে প্রতিষ্ঠিত হোক।
বিদেশে যাওয়ার আগের আর একটি ঘটনা। আবু রোড স্টেশনে গাড়ীতে বসে আছেন স্বামীজী। গাড়ী ছাড়তে তখনও দেরি। গাড়ীর কম্পার্টমেন্টে বসেই তাঁর সঙ্গে গল্প করছেন তাঁর এক বাঙালী অনুরাগী। এমন সময় এক ইউরোপীয়ান টিকিট চেকার এসে সেই ভদ্রলোকটিকে নেমে যেতে বললেন। সেই ভদ্রলোকও রেলকর্মচারী। তিনি সাহেবকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে তিনি নিয়মবিরুদ্ধ কিছু করেননি। সাহেব তা শুনতে চাইলেন না, ফলে দুজনের তর্ক বেধে গেল। তর্ক যখন বেড়ে উঠেছে তখন স্বামীজী মধ্যস্থতা করবার চেষ্টা করলেন। সাহেব ভেবেছিলেন, স্বামীজী সামান্য সন্ন্যাসী। তাই তিনি ধমক দিয়ে উঠলেন : ‘তুম্ কাহে বাত করতে হো।’ এবার স্বামীজী গর্জে উঠলেন : ‘তুম্’ বলছ কেন? ঠিকমতো ব্যবহার করতে জান না? তুমি ফার্স্ট ক্লাস আর সেকেণ্ড ক্লাসের প্যাসেঞ্জারদের দেখাশুনা করে থাক, আর লোকের সঙ্গে ব্যবহার করতে জান না ? 'আপ' বলছ না কেন? বেগতিক দেখে সাহেব এবার ইংরেজিতে বললেন : দুঃখিত। আমি এই ভাষাটা ভাল জানি না। আমি শুধু এই লোকটাকে ... (I only wanted this man...)। স্বামীজীর আর সহ্য হল না । কথা শেষ করতে না দিয়েই তিনি তীব্রকণ্ঠে বলে উঠলেন: তুমি এই বললে হিন্দীভাষাটা ভাল জ্ঞান না। এখন দেখছি তুমি তোমার নিজের ভাষাটাও ভাল জান না। 'লোকটা’ বলছ কাকে? উনি একজন ‘ভদ্রলোক' (Gentleman) । স্বামীজী সাহেবটিকে বললেন যে তাঁর এই দুর্ব্যবহারের কথা তিনি তাঁর উপরওয়ালাকে জানাবেন। ভয় পেয়ে সাহেবটি তখন সুড়সুড় করে সরে পড়লেন। চারদিকে তখন ভিড় জমে গেছে।
স্বামীজীর সঙ্গে ঐ বাঙালী ভদ্রলোক ছাড়াও ছিলেন মুন্সী জগমোহনলাল। সাহেব চলে গেলে পর জগমোহনলালের দিকে ফিরে স্বামীজী বললেনঃ ‘ইউরোপীয়দের সঙ্গে ব্যবহার করতে গেলে আমাদের কি চাই দেখেছ? এই আত্মসম্মানজ্ঞান। আমরা কে, কি দরের লোক না বুঝে ব্যবহার করাতেই লোকে আমাদের ঘাড়ে চড়তে চায়। অন্যের নিকট নিজেদের মর্যাদা বজায় রাখা চাই। তা না হলেই তারা আমাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অপমান করে— এতে দুর্নীতির প্রশ্রয় দেওয়া হয়। শিক্ষা ও সভ্যতায় হিন্দুরা জগতের কোন জাতির চেয়ে হীন নয়, কিন্তু তারা নিজেদের হীন মনে করে বলেই একটা সামান্য বিদেশীও আমাদের লাথি ঝাঁটা মারে—আর আমরা চুপ করে তা হজম করি।'
ভারতবর্ষের মানুষকে স্বামীজী শিখিয়েছিলেন নিজের দেশ ও সংস্কৃতিকে কিভাবে শ্রদ্ধা করতে হয়। বিদেশে পাশ্চাত্য সভ্যতার বৈভবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁর মনে কোন হীনম্মন্যতার বোধ জেগে ওঠেনি। কারণ তিনি অনুভব করেছিলেন, জগতের জন্য পাশ্চাত্যের জড়সভ্যতার চেয়ে ভারতের অধ্যাত্মসভ্যতার প্রয়োজন কোন অংশে কম নয় বরং বেশীই। তাই ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মহিমা তিনি ঘোষণা করেছেন সগর্বে, উচ্চৈঃস্বরে, দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে। তাঁর ঐ দৃঢ়প্রত্যয় এবং সাহসী মনোভাবের জন্যেই পাশ্চাত্যের হাজার হাজার মানুষ ভারত ও ভারতীয় সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেছিল। ধর্মমহাসভায় বিশ্ববাসীর কাছে কোন্ রূপে তিনি প্রতিভাত হয়েছিলেন তার নমুনা হিসাবে উপস্থিত করা যেতে পারে অ্যানি বেশাস্তের বর্ণনা। অ্যানি বেশান্ত বলেছেন : “শিকাগোর ঘন আবহাওয়ার মধ্যে জ্বলন্ত ভারতীয় সূর্য, সিংহতুল্য গ্রীবা ও মস্তক, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, স্প ওষ্ঠ,চকিত দ্রুত গতি, কমলা ও হলুদ রঙের পোষাকে পরমাশ্চর্য ব্যক্তিত্ব, স্বামী বিবেকানন্দ সম্বন্ধে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়ার রূপ এই, ধর্মমহাসভার প্রতিনিধিদের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষে যখন আমি তাঁকে প্রথম দেখলাম। সন্ন্যাসী—তাঁর পরিচয়? নিশ্চয়ই। কিন্তু সৈনিক সন্ন্যাসী তিনি, প্রথম দর্শনে বরং সন্ন্যাসীর চেয়ে সৈনিকই বেশী মনে হয়, মঞ্চ থেকে এখন নেমে এসেছেন, দেশ ও জাতির গর্ব ফুটে আছে দেহের রেখায় রেখায়, পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্মের প্রতিনিধি, পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন কৌতূহলী অর্বাচীনদের দ্বারা, যারা কোনমতেই নিজেদের দাবি ত্যাগে প্রস্তুত নয়, তারা যেন বলতে চায়, তিনি যে সুপ্রাচীন ধর্মের প্রতীক-পুরুষ সেই ধর্ম আশেপাশে সমবেত ধর্মসমূহের মহিমার চেয়ে হীনতর। কিন্তু না, তা হবার নয়, ধাবমান ও উদ্ধত পশ্চিম দেশের কাছে ভারত, যতক্ষণ তার এই বাণীবহ সম্ভান বর্তমান আছে, ততক্ষণ লজ্জিত থাকবে না। ভারতের বাণীকে তিনি বহন করে এনেছেন, ভারতের নামে তিনি দাঁড়িয়েছেন। “সকল দেশের মধ্যে রানী”র মতো যে দেশ থেকে তিনি এসেছেন, তার মর্যাদার কথা স্মরণ রেখেছিলেন এই চারণ সন্ন্যাসী। প্রাণবন্ত, শক্তিধর, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে স্থির স্বামী বিবেকানন্দ পুরুষের মধ্যে পুরুষ, নিজেকে উত্তোলন করার সামর্থ্যসম্পন্ন চরিত্র।
****
আমেরিকার পশ্চিম প্রান্তের একটা নগরীতে স্বামীজী একবার বক্তৃতায় বলেছিলেন : যিনি সর্বোত্তম সত্যে পৌঁছেছেন, বাইরের কোন কিছুই তাঁকে বিচলিত করতে পারে না। কথাগুলি শুনল কয়েকটি ‘কাউবয়’। তারা ঠিক করল স্বামীজীর উপরেই স্বামীজীর এই কথার পরীক্ষা চালাতে হবে। স্বামীজী তাদের গ্রামে বক্তৃতা করতে গেলে তারা একটি টব উলটে তার উপরে দাঁড়িয়ে তাঁকে বক্তৃতা করতে বললেন। স্বামীজী একটুও দ্বিধা না করে তা-ই করলেন এবং মুহূর্তের মধ্যে বক্তৃতার মধ্যে ডুবে গেলেন। এমন সময় তাঁর কানের দুপাশ দিয়ে শোঁ শোঁ শব্দে গুলি ছুটতে লাগল। স্বামীজী কিন্তু একটুও বিচলিত না হয়ে বক্তৃতা চালিয়ে গেলেন। বক্তৃতা শেষ হলে সেই ছেলেগুলি তাঁকে ঘিরে দাঁড়াল, করমর্দন করে বলল : হ্যাঁ, তুমি সত্যিই খাঁটি লোক।
স্বামীজী তখন আমেরিকার সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। কোন এক রেলস্টেশনে ট্রেন থেকে নামামাত্র স্বামীজীকে বিপুলভাবে সংবর্ধনা করা হচ্ছে। এমন সময় একটি নিগ্রো কুলি এসে তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল : সে শুনেছে তিনি তারই স্বজাতীয়, তাঁর গৌরবে নিগ্রোসমাজ গৌরবান্বিত, অতএব সে তাঁর করমর্দনের সৌভাগ্য লাভ করতে চায়। স্বামীজী সঙ্গে সঙ্গে সেই কুলির দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন: 'ধন্যবাদ, ভাই তোমাকে ধন্যবাদ।' কুলিটিকে তিনি বললেন না যে, তিনি নিগ্রো নন। আমেরিকার অনেক হোটেলে তাঁকে নিগ্রো মনে করে ঢুকতে দেওয়া হত না এবং তাঁর প্রতি দুর্ব্যবহার করা হত। কিন্তু কখনও তিনি বলতেন না যে, তিনি নিগ্রো নন। একবার এক পাশ্চাত্য শিষ্য তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন তিনি এইসব ক্ষেত্রে আত্মপরিচয় দেন না। স্বামীজী উত্তর দিয়েছিলেন : “কি, অপরকে ছোট করে আমি বড় হব? আমি তো পৃথিবীতে সেজন্য আসিনি।'
****
ফরাসী দেশের প্রখ্যাত অপেরা গায়িকা মাদাম এমা কালভে। আমেরিকায় তাঁর বিরাট খ্যাতি। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর শান্তি নেই। আকণ্ঠ ভোগবিলাসে নিমগ্ন তিনি। তার উপরে স্বভাবে অত্যন্ত একগুঁয়ে এবং উগ্র ধাঁচের। তাই শান্তি পান না। ১৮৯৪ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে যখন তিনি শিকাগোয় এলেন, তখন তাঁর জীবনে এল মর্মান্তিক এক আঘাত। তাঁর একমাত্র কন্যা শিকাগোতেই আগুনে পুড়ে মারা গেল। শোকে-দুঃখে কালভে প্রায় পাগল হয়ে গেলেন। এই সময় তাঁর এক বান্ধবী তাঁকে স্বামীজীর কাছে নিয়ে যেতে চাইলেন। কালভে রাজী হলেন না। তাঁর মনে হল আত্মহত্যাই তাঁর কাছে একমাত্র পথ। সেই চেষ্টাই করলেন তিনি। বারবার চারবার চেষ্টা করলেন আত্মহত্যা করতে–বিফল হলেন। শেষে একদিন যন্ত্রচালিতবৎ হঠাৎই হাজির হলেন স্বামীজী যেখানে থাকতেন সেখানে। বৈঠকখানা ঘরে অপেক্ষা করছেন, এমন সময় স্বামীজী ডাকলেন ভেতরে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ভেতরে ঢুকে দেখলেন : স্বামীজী ধ্যানাসনে বসে আছেন। চোখ না তুলেই শাও মৃদু স্নিগ্ধ স্বরে স্বামীজী বললেন : 'বাছা, কি ঝড়ো আবহাওয়াই না তুমি নিয়ে এলে। শান্ত হও, এটা একান্ত প্রয়োজন।' এরপর একের পর এক স্বামীজী কালতের জীবনের নানা ঘটনা বলে যেতে লাগলেন, এমনকি এমন সব ঘটনা যা তাঁর নিকটতম বন্ধুরাও জানে না। কালতে বেশ কিছুক্ষণ থাকলেন স্বামীজীর সান্নিধ্যে। তারপর বিদায় নেওয়ার সময় হলে স্বামীজী বললেন : ‘তোমাকে সব ভুলে যেতে হবে। আবার খুশি ও সুখী হও, শরীরটা সুস্থ কর। চুপ করে বসে শুধু দুঃখের কথা ভেবো না।' কালতের সমস্ত অশান্তি আর দুঃখ কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। তাঁর মনে হল : স্বামীজী তাঁর মস্তিষ্কের সমস্ত জটিলতা দূর করে দিয়ে নিজের পবিত্র শান্ত ভাবরাশি সেখানে ঢেলে দিয়েছেন। সেদিন থেকে আবার নতুন করে বাঁচতে শুরু করলেন কালভে।
*****
বিদেশ থেকে ফেরবার সময় একজন ইংরেজ বন্ধু স্বামীজীকে প্রশ্ন করেছিলেন : পাশ্চাত্যের বিলাস-বৈভবের মধ্যে চার বছর কাটানোর পর তাঁর মাতৃভূমি তাঁর কাছে কেমন মনে হবে? স্বামীজী উত্তর দিয়েছিলেন : ‘বিদেশে আসবার আগেও আমি ভারতবর্ষকে ভালবাসতাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভারতের প্রতিটি ধূলিকণা আমার কাছে পবিত্র, ভারতের বাতাস আমার কাছে পবিত্র। ভারত আমার পুণ্যভূমি; আমার তীর্থস্থান।
***
স্বামীজী যখন বিদেশ থেকে ফিরছেন তখন জাহাজে দুজন খ্রীষ্টান মিশনারি গায়ে পড়ে স্বামীজীর সঙ্গে খ্রীষ্টধর্ম ও হিন্দুধর্মের তুলনামূলক আলোচনা করতে লাগলেন। আলোচনায় যখন তাঁরা হারতে লাগলেন, তখন অত্যন্ত জঘন্য ভাষায় হিন্দু ও হিন্দুধর্মের নিন্দা করতে শুরু করলেন। স্বামীজী যতক্ষণ পারলেন ধৈর্য ধরে থাকলেন। কিন্তু শেষে আর পারলেন না। ধীর পদক্ষেপে একজনের কাছে গিয়ে হঠাৎ শক্ত করে তাঁর জামার কলার চেপে ধরলেন। তারপর কৌতুকভরে দৃঢ়স্বরে বললেন : "আবার আমার ধর্মের নিন্দা করলে জাহাজ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেব।' সেই মিশনারি তখন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলছেন : ‘মশায় ছেড়ে দিন, আর কখনও এমন করব না।' এরপর জাহাজে যখনই তাঁর স্বামীজীর সঙ্গে দেখা হত, স্বামীজীর সঙ্গে তিনি খুব ভাল ব্যবহার করতেন। এই ঘটনার উল্লেখ করে স্বামীজী দেশে ফেরবার পর একদিন শ্রীযুক্ত প্রিয়নাথ সিংহকে বলেছিলেন: “আচ্ছা সিংহ, কেউ যদি তোমার মাকে অপমান করে তখন তুমি কি কর?” প্রিয়নাথবাবু উত্তর দিলেন : ‘মশায়, তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে তাকে উত্তম শিক্ষা দিই।' স্বামীজী বললেন : 'বেশ কথা! যদি তোমার ধর্মের প্রতি ঠিক সেরকম অচলা ভক্তি থাকত, তাহলে তুমি কখনও একটিও হিন্দুর ছেলেকে খ্রীষ্টান হতে দেখতে পারতে না। কিন্তু দেখ, রোজ এ ঘটনা ঘটছে। অথচ তোমরা নীরবে রয়েছ। বাপু, তোমাদের বিশ্বাস কই? দেশের প্রতি মমতা কই? মুখের উপর প্রতিদিন পাদরিরা তোমাদের ধর্মকে অজস্র গালিগালাজ করছে; কিন্তু কজন তার প্রতিকার করবার চেষ্টা করছ? তোমাদের মধ্যে কজনের রক্ত তাতে গরম হয়ে ওঠে?"
*******
স্বামীজী আমেরিকা থেকে ফেরবার পর আলোয়ারে এসেছেন। স্টেশনে অগণিত বন্ধু, অনুরাগী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এসেছেন তাঁকে দেখতে। হঠাৎ স্বামীজীর চোখে পড়ল—দূরে দীনহীন বেশে তাঁর এক অনুরক্ত ভক্ত দাঁড়িয়ে আছে। বহুদিন পরে স্বামীজীকে দর্শন করার আনন্দ তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে, সে-ও চায় স্বামীজীর সান্নিধ্য লাভ করতে—কিন্তু গণ্যমান্যদের ভিড় ঠেলে স্বামীজীর কাছে আসতে তার সাহসে কুলোচ্ছে না। স্বামীজী কিন্তু তাঁর ভক্তকে দেখামাত্রই স্থান-কাল, আদবকায়দা, লোকলজ্জা ভুলে চেঁচিয়ে ডেকে উঠলেন : ‘রামস্নেহী, রামস্নেহী।’ চারপাশের ভিড় ঠেলে তাকে কাছে ডেকে আনলেন, তারপর আগেরই মতো প্রাণ খুলে তার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন।
******
আলোয়ার রাজ্যের অনেক ধনী ভক্তের কাছ থেকে আমন্ত্রণ এসেছে। কিন্তু একজন দরিদ্র বৃদ্ধার নিমন্ত্রণই স্বামীজী সবচেয়ে আগে সবচেয়ে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করলেন। মনে পড়ল, পরিব্রাজক জীবনে একবার তিনি এই বৃদ্ধার কাছে ভিক্ষা গ্রহণ করে খিদে মিটিয়েছিলেন। স্বামীজী বলে পাঠালেন, তার হাতে আবার সেই মোটা মোটা চাপাটি খেতে চান। স্বামীজী এসেছেন বৃদ্ধার বাড়িতে, শিষ্যদেরও নিয়ে এসেছেন। বৃদ্ধার আনন্দ আর ধরে না। স্বামীজীর কথামতো সে মোটা মোটা চাপাটি করেছে। মহাতৃপ্তিতে স্বামীজী খাচ্ছেন আর বলছেন : আহা, বুড়িমার কী স্নেহ–আর এই চাপাটিগুলোই বা কী সাত্ত্বিক ! বিদায় নেবার আগে দরিদ্র বৃদ্ধার সেবার জন্য বৃদ্ধার অগোচরে স্বামীজী একটি একশ টাকার নোট গৃহস্বামীর হাতে দিয়ে এলেন।
*******
বলরাম বসুর বাড়িতে স্বামীজী একদিন তন্ময় হয়ে বেদ ব্যাখ্যা করছেন। উপস্থিত আছেন শিষ্য শরত্চন্দ্র চক্রবর্তী এবং গিরিশচন্দ্র ঘোষ। তাঁরা মুগ্ধচিত্তে শুনছেন স্বামীজীর যুক্তিপূর্ণ সরস ব্যাখ্যা। কিছুক্ষণ পরে গিরিশ ঘোষ বললেন : নরেন, একটা কথা বলি। বেদ-বেদান্ত তো ঢের পড়লে, কিন্তু এই যে দেশে ঘোর হাহাকার, অন্নাভাব, ব্যভিচার, মহাপাপ—এর উপায় তোমার বেদে কিছু বলেছে? অমুকের বাড়ির গিন্নী, এককালে যার বাড়িতে রোজ পঞ্চাশখানা পাতা পড়ত, সে আজ তিন দিন হাঁড়ি চাপায়নি; অমুক বাড়ির ভদ্রমহিলা গুণ্ডাদের আক্রমণে মারা গেছেন; অমুক বাড়ির বিধবার সমস্ত সম্পত্তি একজন জোচ্চুরি করে নিয়ে নিয়েছে—এইসবের প্রতিকার করবার কোন উপায় তোমার বেদে আছে কি? গিরিশবাবু যখন এইভাবে একের পর এক সমাজের বিভীষিকার ছবিগুলো তুলে ধরতে লাগলেন, স্বামীজী তখন নির্বাক হয়ে গেলেন, বেদ ব্যাখ্যা বন্ধ হয়ে গেল। তাঁর চোখে জল দেখা দিল। কান্না চাপবার জন্য তিনি ঘরের বাইরে চলে গেলেন।
তখন গিরিশ ঘোষ শরচন্দ্র চক্রবর্তীকে বললেন : দেখলি বাঙাল (শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী বাঙাল ছিলেন), কত বড় প্রাণ! তোর স্বামীজীকে কেবল বেদজ্ঞ পণ্ডিত বলে মানি না; কিন্তু ঐ যে জীবের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল, এই মহাপ্রাণতার জন্য মানি। চোখের সামনে দেখলি তো মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথাগুলো শুনে স্বামীজীর হৃদয় করুণায় পূর্ণ হয়ে উঠল, বেদ-বেদান্ত সব কোথায় উড়ে গেল।
*****
বিদেশ থেকে ফেরবার পর অসুখে-বিসুখে স্বামীজীর শরীর খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ডাক্তারদের নির্দেশে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য তিনি গেলেন দার্জিলিঙে। দার্জিলিঙে কিছুদিন থাকার পর স্বামীজী খবর পেলেন কলকাতায় প্লেগ দেখা দিয়েছে। এর আগেই স্বামীজী প্লেগের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। দার্জিলিঙ থেকে ম্যাকলাউডকে লেখা একটা চিঠিতে স্বামীজীর সেই সময়কার মনোভাব জানা যায়। স্বামীজী তাঁকে লিখেছিলেন (২৯ এপ্রিল ১৮৯৮) : ‘আমি যে-শহরে জন্মেছি, সেখানে যদি প্লেগ এসে পড়ে, তবে আমি তার প্রতিকার-কল্পে আত্মোৎসর্গ করব বলেই স্থির করেছি; আর জগতে যত জ্যোতিষ্ক আজ পর্যন্ত আলো দিয়েছে, তাদের উদ্দেশে আহুতি দেওয়ার চেয়ে এ উপায়টা আমার নির্বাণ লাভের প্রকৃষ্টতর উপায়। যখন খবর এল কলকাতায় সত্যিই প্লেগ দেখা দিয়েছে এবং ত ক্রমশ মহামারীর আকার নেওয়ার সম্ভাবনা, স্বামীজী একটুও দেরি না করে কলকাতায় চলে এলেন। এসে দেখলেন, প্লেগে যত না মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার চেয়ে বেশী দেখা দিয়েছে মানুষের মনে আতঙ্ক। দলে দলে মানুষ প্রাণের ভয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। মানুষের মনে সাহস দেবার জন্য স্বামীজী জনসাধারণের মধ্যে ঘোষণাপত্র বিলি করে জানালেন : রামকৃষ্ণ মিশন তাদের পাশে আছে; তাদের সেবায় মিশন অকুণ্ঠিত চিত্তে অর্থ ও সামর্থ্য নিয়োগ করবে। এছাড়াও স্বামীজী স্থির করলেন, জায়গায় জায়গায় প্লেগ-আক্রান্তদের জন্য সেবাকেন্দ্র স্থাপন করবেন। কিন্তু তার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। কোত্থেকে আসবে টাকা? একজন গুরুভাই এই প্রশ্ন করলেন। স্বামীজী তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন : 'কেন? দরকার হলে নূতন মঠের জমিজায়গা সব বিক্রি করব। আমরা ফকির; মুষ্টিভিক্ষা করে গাছতলায় শুয়ে দিন কাটাতে পারি। যদি জায়গা-জমি বিক্রি করলে হাজার হাজার লোকের প্রাণ বাঁচাতে পারা যায় তো কিসের জমি?' প্রয়োজনীয় অর্থ অন্যসূত্রে এসে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত অবশ্য মঠ বিক্রি করতে হয়নি। কিন্তু কত বড় মহাপ্রাণ ছিলেন স্বামীজী, তার পরিচয় আমরা ঐ উক্তিতে পেলাম। এই মঠ স্থাপনের জন্য তিনি কী প্রাণপাত পরিশ্রমই না করেছেন, হৃদয়ের বেলুড় রক্ত মোক্ষণ করে তিল তিল করে অর্থসংগ্রহ করে এই মঠ গড়ে তুলেছেন। কিন্তু আর্ত মানুষের দুর্দশা যেই দেখলেন, অমনি সেই মঠ-বাড়ি বিক্রির কথা বলতে একটুও বুকে বাজল না তাঁর!
*******
স্বামীজী দ্বিতীয় এবং শেষ বারের মতো পাশ্চাত্যে এসেছেন। আমেরিকায় একদিন তিনি একটা নদীর ধারে বেড়াচ্ছেন। হঠাৎ চোখে পড়ল : কয়েকটি যুবক সাঁকোর উপরে দাঁড়িয়ে জলে ভেসে থাকা কয়েকটা ডিমের খোলার দিকে গুলি ছুঁড়ছে। বারবার চেষ্টা করছে—কিন্তু একবারও পারছে না। দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে স্বামীজীর মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। যুবকদের একজনের অ চোখে পড়ল। স্বামীজীকে চ্যালেঞ্জ করে সে বলল: কাজটা যতটা সহজ দেখাচ্ছে ততটা সহজ নয়। দেখি তো আপনি কেমন পারেন! স্বামীজী দ্বিরুক্তি না করে তাদের কাছ থেকে একটা বন্দুক নিলেন, তারপর পরপর বারোটি খোলা গুলিবিদ্ধ করলেন। যুবকরা অবাক হয়ে গেল। তারা ভাবল, ইনি নিশ্চয় বহুদিন ধরে বন্দুক ছুঁড়েছেন। স্বামীজী তাদের বললেন : তিনি এর আগে কখনই বন্দুকে হাত দেননি। তিনি যে লক্ষ্যভেদ করতে পারলেন তার রহস্য হচ্ছে মনঃসংযম।
******
স্বদেশে ফেরবার পথে স্বামীজী ইজিপ্ট হয়ে যাচ্ছেন। কায়রোতে এসেছেন, সঙ্গে আছেন কয়েকজন বিদেশী শিষ্য-শিষ্যা। কায়রোর রাজপথে সঙ্গীদের নিয়ে চলতে চলতে স্বামীজী একদিন ভুল করে সেই জায়গায় চলে এসেছেন যেখানে পতিতা রমণীরা থাকে। সঙ্গীরা যখন বুঝতে পারলেন, তৎক্ষণাৎ স্বামীজীকে নিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে চাইলেন। কিন্তু স্বামীজী ততক্ষণে তাঁদের ছেড়ে এগিয়ে গেছেন রাস্তার পাশে বসে থাকা কয়েকটি রমণীর দিকে। তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলতে লাগলেন : ‘আহা বাছারা! আহা অভাগিনীরা! ওরা ওদের সৌন্দর্যের পায়ে নিজেদের দেবীত্বকে বলি দিয়েছে।' তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। ঐ রমণীরা এর আগে হাসতে হাসতে চপল ভঙ্গিতে তাঁকে ডাকছিল। এখন তারাই লজ্জায় মাথা নীচু করল। একজন তাঁর বসনপ্রাপ্ত চুম্বন করে বলতে লাগল : ইনি ঈশ্বরকে জেনেছেন, ইনি ভগবানের লোক। আর একজন দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে স্বামীজীর পবিত্র চোখদুটির দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করতে চেষ্টা করল।
**********
একবার ট্রেনে যেতে যেতে স্বামীজী দেখলেন, একজন মুসলমান ফেরিওয়ালা ছোলাসিদ্ধ বিক্রি করছে। সঙ্গের ব্রহ্মচারীকে স্বামীজী বললেন : ‘ছোলাসিদ্ধ খেলে বেশ হয়; বেশ স্বাস্থ্যকর জিনিস।’ ব্রহ্মচারী এক পয়সার ছোলা কিনলেন, কিন্তু ফেরিওয়ালাকে দাম হিসেবে দিলেন চার আনা। কারণ, স্বামীজীর স্বভাবের সঙ্গে তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ছোলা কেনার ছলে স্বামীজী আসলে ফেরিওয়ালাকে সাহায্য করতে চান। স্বামীজী জিজ্ঞাসা করলেন : 'কিরে, কত দিলি?’ ‘চার আনা। স্বামীজী বললেন : ‘ওরে, ওতে ওর কি হবে? দে, একটা টাকা দিয়ে দে। ঘরে ওর বউ আছে, ছেলেপিলে আছে।' তা-ই করা হল। স্বামীজী নিজে কিন্তু একটা ছোলাও খেলেন না।
******
বেলুড় মঠে স্বামীজী যে-ঘরে থাকতেন তার পাশের ঘরেই থাকতেন স্বামী বিজ্ঞানানন্দ। একদিন রাত দুটোর সময় বিজ্ঞানানন্দের ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে বেরিয়ে দেখলেন, স্বামীজী বারান্দায় অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। বিজ্ঞানানন্দ জিজ্ঞাসা করলেন: “কি স্বামীজী ! আপনার ঘুম হচ্ছে না? স্বামীজী বললেন : ‘বেশ ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ যেন একটা ধাক্কা লাগল আর আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমার মনে হয়, কোন জায়গায় একটা দুর্ঘটনা হয়েছে এবং অনেক লোক তাতে দুঃখ-কষ্ট
পেয়েছে।" বিজ্ঞানানন্দ মনে মনে হাসলেন : ‘কোথায় কি দুর্ঘটনা হল আর স্বামীজীর এখানে ঘুম ভেঙে গেল—এটা কি সম্ভব!' কিন্তু আশ্চর্য! পরদিন সকালের খবরের কাগজে দেখা গেল, ফিজির কাছে একটা দ্বীপে অগ্ন্যুৎপাত হয়ে বহু লোক মারা গেছে। অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল ঠিক সেই সময়টায়—যে সময় কিসের যেন আঘাতে স্বামীজীর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।
******
স্বামীজী ভারতবর্ষের অতীত মহিমার কথা শতমুখে বলতেন। কিন্তু তিনি মনে করতেন ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষ অতীতের থেকেও আরও বড় হবে। স্বামীজী একদিন বেলুড় মঠে বসে বলেছিলেন : 'ভারতবর্ষের আগামী চার-পাঁচশো বছরের ইতিহাসের পাতা উলটে গেল, সব দেখে ফেললাম।
জীবনসায়াহ্নে আর একদিন বলেছিলেন: ‘আগামী পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যে ভারত স্বাধীন হবে। কিন্তু যেভাবে সাধারণত দেশ স্বাধীন হয়, সেভাবে নয়। কুড়ি বৎসরের মধ্যেই একটা মহাযুদ্ধ হবে। পাশ্চাত্য দেশগুলি যদি materialism না ছাড়ে, তাহলে আবার যুদ্ধ অনিবার্য। স্বাধীন ভারতবর্ষ ক্রমে পাশ্চাত্যের materialism নেবে। প্রাচীন ঐহিক গৌরবকে নতুন ভারত ম্লান করে দেবে। আমেরিকা প্রভৃতি দেশ উত্তরোত্তর অধ্যাত্মবাদী হবে। তারা জড়বাদের শিখরে পৌঁছে বুঝেছে, জড়ে শান্তি দিতে পারে না।' আর একবার স্বামীজী বলেছিলেন : ইংরেজরা ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাবার পর চীনের দ্বারা ভারতবর্ষ অধিকৃত হবার বিরাট আশঙ্কা আছে।
স্বামীজীকে তাঁর এক বিদেশিনী ‘বন্ধু’ (মিস ম্যাকলাউড) প্রশ্ন করেছিলেন : 'স্বামীজী, আমি কিভাবে আপনাকে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করতে পারি?” স্বামীজী উত্তর দিয়েছিলেন : ‘ভারতবর্ষকে ভালবাস।'
স্বামীজী একবার নিজের সম্বন্ধে বলেছিলেন: আমি 'Condensed India'—ভারতবর্ষের ঘনীভূত রূপ আমিই। ভারতবর্ষকে ভালবেসে স্বামীজী হয়ে উঠেছিলেন স্বয়ং ভারতবর্ষ। নিবেদিতাও সেই কথাই বলেছেন: ‘ভারতবর্ষ ছিল স্বামীজীর গভীরতম আবেগের কেন্দ্র ভারতবর্ষ নিত্যস্পন্দিত হত তাঁর বুকের মধ্যে, প্রধবনিত হত তাঁর ধমনীতে, ভারতবর্ষ ছিল তাঁর দিবাস্বপ্ন, ভারতবর্ষ ছিল তাঁর নিশীথের দুঃস্বপ্ন। শুধু তাই নয়, তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন ভারতবর্ষ রক্তমাংসে গড়া ভারত-প্রতিমা।... ভারতের আধ্যাত্মিকতা, তার পবিত্রতা, তার প্রজ্ঞা, তার শক্তি, তার স্বপ্ন এবং তার ভবিষ্যৎ—সবকিছুর তিনি ছিলেন প্রতীকপুরুষ।
স্বামীজীর জীবনী পড়লে সেইজন্য মনে হয় ভারতবর্ষের গর্বে এত গর্বিত বুঝি আর কেউ হননি, ভারতবর্ষের দুঃখে এত বেদনা আর কেউ বুঝি পাননি, আবার ভারতবাসীর অক্ষমতায় এত নির্মম কশাঘাতও বুঝি আর কেউ করেননি। কারণ, ভারতবর্ষকে এত আপনার করে আর কেউ চেনেননি। মা যেমন সন্তানের সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দ, দুর্বলতা, প্রয়োজন, বিপদ এবং সম্ভাবনার কথা সন্তানের নিজের চেয়েও বেশী করে জানেন, ঠিক তেমনি ভাবে স্বামীজী ভারতবর্ষকে চিনেছিলেন। তাই, অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ভারতের এক একটা পরিপূর্ণ ছবি তাঁর চিন্তায় রূপ পেয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ এইজন্যই রোমাঁ রোলাকে বলেছিলেন : যদি ভারতবর্ষকে জানতে চাও তো বিবেকানন্দ পড়।
✍️স্বামীজী সম্বন্ধে মনীষীগণ :-
🖋️নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু:-
শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের নিকট আমি যে কত ঋনি তাহা ভাষায় কি করিয়া প্রকাশ করিব? তাঁহাদের পূন্য প্রভাবে আমার জীবনের প্রথম উন্মেষ। চরিত্র গঠনের জন্য" "রামকৃষ্ণ - বিবেকানন্দ সাহিত্য" অপেক্ষা উৎকৃষ্ট সাহিত্য আমি কল্পনা করতে পারি না।
🖊️রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:-
যদি তুমি ভারতকে জানতে চাও , বিবেকানন্দ কে জানো। তাঁর মদ্যে সবকিছুই ইতিবাচক , নেতিবাচক কিছু নেই।
বিবেকানন্দ বলেছিলেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ব্রহ্ম এর শক্তি। বলেছিলেন, দরিদ্রের মধ্যে দিয়ে নারায়ন আমাদের সেবা পেতে চান।
✒️মহাত্মা গান্ধী:-
তাঁর রচনাবলী আমি অত্যন্ত মনযোগ সহকারে অনুশীলন করেছি এবং সেগুলি পাঠ করার পর আমার মাতৃভূমির প্রতি আমার ভালবাসা সহস্রগুন বেড়ে গিয়েছে।
✏️চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী:-
আমাদের আধুনিক ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে যে কেউ স্পষ্ট দেখতে পাবে বিবেকানন্দের কাছে আমরা কত ঋণী! ভারতের আত্মমহিমার দিকে ভারতের নয়ন তিনি উন্মীলিত করে দিয়েছিলেন। তিনি রাজনীতির আধ্যাত্মিক ভিত্তি নির্মাণ করেছিলেন। আমরা অন্ধ ছিলাম, তিনি আমাদের দৃষ্টি দিয়েছেন। তিনিই ভারতীয় স্বাধীনতার জনক,— আমাদের রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার তিনি পিতা।
🕉️স্বামীজীর রচিত মন্ত্র:-
• অম্বা স্তোত্র (কা ত্বং শুভে শিবকরে সুখ দুঃখ হস্তে ৷)
• শ্রীরামকৃষ্ণ আরাত্রিক স্তব (খন্ডন ভব বন্ধন)
• শ্রীরামকৃষ্ণ স্তোত্রম (ওঁ হ্রীং ঋতং )
• "আচন্ডালাপ্রতিহত রয়: যস্যাপ্রেমপ্রবাহ..."
(এছাড়াও স্বামীজী কিছু আধ্যাত্মিক গান ও কবিতাও রচনা করেছিলেন, এবং তিনি বাংলা, সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষায় বহু অনুবাদ ও করেছিলেন)
🕉️স্বামীজির বজ্রদৃঢ় বাণী:-
★সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায় কিন্তু কোনো কিছুর জন্যই সত্যকে ত্যাগ করা যায় না।
★বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে জেইজ সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।
★শিব জ্ঞানে জীব সেবা, যত্র জীব তত্র শিব
★উত্তিষ্ঠত, জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত :- ওঠো, জাগো, লক্ষ্যে পৌঁছানো না পর্যন্ত থেমো না।
★বহুজনহিতায়চ বহুজনসুখায়চ কর্ম করো।
★টাকায় কিছুই হয় না, নামেও হয় না, যশেও হয় না, ভালোবাসায় সব হয়—চরিত্রই বাধাবিঘ্নের বজ্র দৃঢ় প্রাচীরের মধ্যে দিয়ে পথ করে নিতে পারে।
★মানুষকে পাপী বলাও পাপ।
★চালাকির দ্বারা কোনো মহৎ কার্য হয় না ।
★খালিপেটে ধর্ম হয় না, প্রথমে অন্নের ব্যবস্থা করতে হবে, তারপর ধর্ম।
★যে ধর্ম বিধবার অশ্রু মোচন করতে পারে না, ক্ষুধার্ত শিশুর মুখে এক টুকরো রুটি তুলে দিতে পারে না, আমি সেই ধর্মকে বিশ্বাস করি না।
★নিজের উপর বিশ্বাস না এলে ঈশ্বরে বিশ্বাস আসে না।
★সম্প্রসারণই জীবন, সঙ্কীর্ণতাই মৃত্যু; প্রেমই জীবন, দ্বেষই মৃত্যু।
(***স্বামীজির প্রত্যেকটি অমূল্যকথাই তাঁর অমৃততুল্য বাণী, তাঁর উপদেশ, তাঁর সব বাণী, উপদেশ মুখে বলে বা লিখে ব্যক্ত করা অসম্ভব, তাঁহার সম্বন্ধে যত বলা হয় ততই কম বলে মনে হয়, তাই কিছুমাত্র উপদেশ প্রদান করা হইলো।***)
*******
বইয়ের নাম- সবার স্বামীজী
লেখক- স্বামী লোকেশ্বরানন্দ
🙏🍁🌼🌿🌱স্বামীজীর জন্মদিনে স্বামীজীকে এই ক্ষুদ্র শ্রধ্যাঞ্জলি অর্পন করে তাঁর এই ক্ষুদ্র,তুচ্ছ দাস ও ভক্ত স্বামীজী কে শত সহস্র কোটি প্রনাম জানায়।💐🌷🌺🌸💮🌾
☘️🙏প্রনাম হে প্রভু স্বামীজী বিবেকানন্দ।🙏☘️