Monday, 16 May 2022

বুদ্ধ পূর্ণিমা


 শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা ☸️🙏♥️🏵️💐


আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে আজকের দিনে এক আশ্চর্য মানুষ জন্মেছিলেন। 


তখন ভারতবর্ষের ধর্মাকাশে এক ক্রান্তির সময়। বৈদিক যাগযজ্ঞের উদ্দেশ্য ও বিধেয় নিয়ে বৈশ্য ও শূদ্রদের মনে নানা প্রশ্ন জেগেছে। তাঁদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধছে৷ ব্রাহ্মণরা করের আওতার বাইরে, আর ক্ষত্রিয়রা দেশশাসক, স্বয়ং কর সংগ্রাহক। ফলে দেশের অর্থনীতির জোয়াল বৈশ্য এবং শূদ্রদের কাঁধে। তাঁরা এই ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। সেই প্রশ্ন ক্ষত্রিয়রা যে বুঝতে পারছেন না তা নয়, তাঁরাও বৈদিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের যাগযজ্ঞ এবং পশুবলির অসারতা অনুভব করতে পারছেন, কিন্তু কোনও সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছেন না। তাঁরা যুক্তির সোপানে পা রেখেছেন, কিন্তু ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের নিগড় ছেড়ে বেরোতে সাহস পাচ্ছেন না। কারণ তাঁরাও এতদিন ধরে বৈশ্যদের থেকে কর আদায় করেছেন, শূদ্রদের থেকে নিঃশুল্ক শ্রম। সেই জন্য এই দুই শ্রেণীর সমর্থনও তাঁদের আয়ত্বের বাইরে।  


ঠিক এই সময়েই কপিলাবস্তু'র লুম্বিনী উদ্যান আলো করে নেমে এলেন এমন এক মানুষ যিনি যাগযজ্ঞ পশুবলি মন্ত্র তন্ত্র, যুদ্ধবিগ্রহ বা পরধর্মনিপীড়ন নয়, আত্মশক্তিকেই মুক্তির একমাত্র সোপান বলে চিহ্নিত করেছিলেন। যিনি করুণাঘন হৃদয়ে উচ্চারণ করেছিলেন "সব্বে সত্তা সুখিতা হোন্তু, অবেরা হোন্তু, অব্যাপজ্‌ঝা হোন্তু, সুখী অত্তানং পরিহরন্তু, সব্বে সত্তা মা যথালব্ধসম্পত্তিতো বিগচ্ছন্তু। সকল প্রাণী সুখিত হোক, শত্রুহীন হোক, সুখী অহিংসিত হোক, সুখী আত্মা হয়ে কালহরণ করুক। সকল প্রাণী আপন যথালব্ধসম্পত্তি হতে বঞ্চিত না হোক।" তাঁর সেই বোধি ও প্রজ্ঞার আলোকে এই চরাচর আজও আলোকময় হয়ে আছে।।

কিন্তু সেই বোধিলাভের মাহেন্দ্রক্ষণ এমনি এমনি আসেনি। এই একই তিথিতে ঘটেছিল আরও এক আশ্চর্য ঘটনা। সেই কথাই আপনাদের বলবো। 


সেদিনও ছিলো এমনই এক স্নিগ্ধ শ্যামল সন্ধ্যা। গোপকন্যা সুজাতার দেওয়া পায়সান্ন গ্রহণ করে শাক্যসিংহ সিদ্ধার্থ বোধিদ্রুমের ছায়ায় নরম ঘাসে বোনা আসটিতে বসে সাধনায় দৃঢ়সংকল্প হলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, জগতের হিতের পথ না জেনে, নিপীড়িত লাঞ্ছিত মানুষের মুক্তির ইশারা না চিনে এই সাধনা থেকে প্রত্যাবৃত্ত হবেন না, 

ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং

ত্বগস্থি মাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু।

অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্পদুর্লভাং

নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে॥


[এই আসনে আমার শরীর শুকিয়ে গেলে যাক, ত্বক, অস্থি, মাংস, ধ্বংস হলে হোক, তবুও বহুকল্পদুর্লভ বোধিলাভ না করে আমার দেহ এই আসন থেকে উঠবে না।]


আকাশ থেকে বজ্রের মতো, পাতাল থেকে অভিশাপের মতো, অন্ধকার থেকে দৈত্যের মতো ধেয়ে এলেন মার। সঙ্গে এলো বিভ্রম, হর্ষ ও দর্প আর রতি, আরতি ও তৃষ্ণা। তারা মারের তিনপুত্র, তিন কন্যা। তারা থাকে মানুষের মনের গহীন অন্ধকারে, ভোগে, কামনায়। পাপের পাতালে তাদের বাস, প্রলোভনের বাসনায় তাদের সিদ্ধি। কিন্তু যে অমিতপ্রভ শাক্যসিংহ আজ বুদ্ধ হবার জন্য দৃঢ়চিত্ত হয়েছেন, সামান্য মানুষীর কামনার সাধ্য কি তাঁর সামনে দাঁড়ায়?


মেরু পৰ্ব্বতরাজ স্থানতু চলেৎ সৰ্ব্বং জগন্নোভবৎ

সৰ্ব্বে তারকসঙ্ঘ ভূমি প্রপেতৎ সজ্যোতিষেন্দ্রা নভাৎ।

সৰ্ব্বে সত্ত্ব করেয় একমতয়ঃ শুষ্যেন্মহাসাগরো

নত্বেব দ্রুমরাজ মূলোপগতশ্চাল্যেত অস্মদ্বিধঃ।।


[যদি পৰ্ব্বতরাজ মেরু স্থানচ্যুত হয়, সমস্ত জগৎ শূন্যে মিশে যায়, সূর্যের সঙ্গে সমস্ত নক্ষত্রপুঞ্জ আকাশ থেকে ভূমিতে পতিত হয়, বিশ্বের সকল জীব একমত হয়, মহাসমুদ্র শুকিয়ে যায়, তবুও আমাকে এই বোধিবৃক্ষের আসন থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত করতে পারবে না]


অবশেষে স্বয়ং মার স্বয়ং অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে, সসৈন্যে সিদ্ধার্থের সঙ্গে বজ্রসংগ্রামে প্রবৃত্ত হলেন।কিন্তু বৃথা চেষ্টা।বহুতর ভয়, ক্রোধ, প্রলোভন, কুতর্কের পর মার পরাস্ত হলেন। তিনি সিদ্ধার্থের সাধনায় বিন্দুমাত্র বিঘ্ন ঘটাতে পারলেন না   


সৰ্ব্বেয়ং ত্রিসহস্র মেদিনী যদিমারৈঃ প্রপূর্ণা ভবেৎ

সৰ্ব্বেষাং যথ মেরু পৰ্ব্বতবরঃ পাণীষু খড়্গো ভবেৎ।

তে মহ্যং ন সমর্থ লোম চালিতুং প্রাগেব মাং যাতিতুং

কুৰ্য্যাচ্চাপি হি বিগ্রহে স্ম বৰ্ম্মিতেন দৃঢ়॥


[এই তিন সহস্র ভূমি যদি মারে পরিপূর্ণ হয়, প্রত্যেক মারের খড়্গ যদি পর্বতশ্রেষ্ঠ সুমেরুর মতো বিশাল হয়, তবুও সাধনার সুদৃঢ় বর্মে আচ্ছাদিত আমাকে পরাস্ত করা দূরে থাকুক, মার আমাকে একবিন্দু বিচ্যুত করতে পারবে না।]    


মারকে জয় করে সিদ্ধার্থ বুদ্ধত্বলাভে প্রবৃত্ত হলেন। রাত্রির প্রথম যামে তাঁর দিব্যচক্ষু জাগ্রত হলো। দ্বিতীয় যামে তিনি জাতিস্মর জ্ঞান বা পূর্বজন্মের বিষয় জ্ঞাত হলেন। তৃতীয় যামে জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুর উৎপত্তির বিষয়ে অবগত হলেন। অবশেষে তিনি উপলব্ধি করলেন চার আর্যসত্য, অবহিত হলেন অষ্টাঙ্গিক মার্গ সম্পর্কে। সিদ্ধার্থ সম্যক সম্বুদ্ধ হলেন, গৌতম বুদ্ধ হলেন।  


আজ সেই দিন। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে পৃথিবীর জন্য খুলে গেছিলো অমৃতের অযুত দ্বার। নিজের অধ্যবসায়ে, ত্যাগে, করুণায়, তিতিক্ষায় রাজপুত্র সিদ্ধার্থ একজন সাধারণ মানুষ থেকে মহামানব বুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তপস্যার আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, 


অপরূপা তেসং অমতস্য দ্বারা

যে সোতবন্তো পমুঞ্চন্তু সদ্ধং,

বিহিঞ্চ সঞঞী পগুণং ন ভাসিং,

ধম্মং পণীতং মনুজেসু ব্রহ্মে।।


[অমৃতের দ্বার আজ উন্মুক্ত। যারা শুনতে পারো তারা শোনো। শ্রদ্ধাদ্বারাই এই অমৃতের সাক্ষাৎ লাভ হবে। হিংসা অপগুণ থেকে মুক্ত হও। ধর্ম এইভাবেই মানুষকে সার্থক করে]


তিনি বুদ্ধত্ব অর্জন করে তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন, "চরথ ভিক্খবে চারিকং বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়’—ভিক্ষুগণ, বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য, লোকের প্রতি পরম অনুকম্পা পরবশ হয়ে দিকে দিকে এই কল্যাণ ধর্ম প্রচার কর।" তাঁর শেষ উপদেশ ছিলো "আত্মদীপ ভব, আত্মশরণ ভব, অনন্যশরণ ভব, নিজেই নিজের প্রদীপ হও।"


জগতের সেই শ্রেষ্ঠ মহামানব, ভগবান তথাগত'র আজ আবির্ভাব দিবস। এই বৈশাখী পূর্ণিমার দিনেই তিনি মারকে জয় করে বুদ্ধ হন৷ আবার এই তিথিতেই তিনি সিংহশয়ানে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। মানুষকে বলেছেন ভয়হীন হতে, দ্বেষহীন হতে, ভেদবুদ্ধিহীন হতে। অক্রোধের দ্বারা ক্রোধকে জয় করার কথা বলেছেন, শ্রদ্ধাদ্বারা করুণার মন্দিরে অর্ঘ্যদানের কথা বলেছেন।বাঙালী কবি তাঁকে প্রণাম জানিয়ে লিখেছেন, "উদিল যেখানে বুদ্ধ-আত্মা মুক্ত করিতে মোক্ষ দ্বার ; আজিও জুড়িয়া অর্ধজগৎ ভক্তি-প্ৰণত চরণে যাঁর।" 


ভারতের যা কিছু পুন্য, যা কিছু শুভ, যা কিছু মাঙ্গলিক, তার মূর্ত প্রতীক ওই একজনই, পরমকারুণিক তথাগত, ভগবান বুদ্ধ। আজও তিনি আমাদের জাগ্রত চৈতন্য, ভারতবর্ষের অন্তরাত্মা।


শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা🙏♥️🏵️💐

জয় ঠাকুর মা স্বামীজী 🙏♥️🏵️💐

Tuesday, 3 May 2022

Shri Ramakrishna kathamrita

                         


‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’-এ যুগের সর্বোচ্চ ধর্ম সাহিত্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ যাঁর মধ্যে লক্ষ্য করেছেন বহু সাধনার ধারার মিলন, শ্রীঅরবিন্দ যাঁকে অনন্তের স্রোতোধারার সাক্ষীপুরুষরূপেই শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন এবং বিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক রোমাঁ রোলাঁ যাঁর সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘ত্রিশ কোটি নরনারীর দুই সহস্রব্যাপী আধ্যাত্মিক জীবনের পরিপূর্ণ রূপ তিনি’, সেই অবতারবরিষ্ঠ শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ও বাণীর ধারক ও বাহক কথামৃত গুণগত কারণেই এ যুগের শ্রেষ্ঠ ধর্ম সাহিত্যের তলিকায় থাকবে।
যদিও স্বামী সারদানন্দ রচিত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ’ এবং  অক্ষয়কুমার সেন রচিত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথি’ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার  ভিত্তিতেই রামকৃষ্ণ-মহাজীবনকে বিশ্বসমক্ষে তুলে ধরেছে, তবুও বলতে দ্বিধা নেই, সাক্ষাৎ শ্রীরামকৃষ্ণকে আমরা যতখানি জীবন্ত আকারে কথামৃতের মধ্যে পাই, তেমন আর কোথাও পাই না। জীবনীর মধ্যে জীবনটাকে চাই, শুধু ব্যাখ্যা আর বিশ্লেষণ চাই না, অথবা শ্রদ্ধা নিবেদনের বাহুল্যও প্রত্যাশা করি না। সেদিক  থেকে বিচার করলে কথামৃতে আমরা শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনটিকে পাই নিখুঁত আঙ্গিকে,  পাই হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের জাগতিক সম্পদে, পাই উচ্চতম আদর্শের ভাবসম্পদে। ফলে কথামৃত শুধু গ্রন্থ নয়, সর্বোচ্চ ধর্মীয় সাহিত্যে রূপান্তরিত। 
১৮৮২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কথামৃত রচনার সূচনা করেন মাস্টারমশাই মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত যিনি শ্রীম নামে খ্যাত। আর কথামৃতের পঞ্চম বা শেষ খণ্ড  প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। শ্রীময়ের দেহত্যাগের কিছুদিন পরে। ১৯৮২ সাল তাই  আরেক দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। গ্রন্থস্বত্ব আইন অনুসারে ঐ বছরই কথামৃতের  প্রকাশক কথামৃত ভবনের গ্রন্থস্বত্বেরও অবসান হয়েছে।
রামকৃষ্ণ কথামৃতের মাধ্যমে মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত চলিত বাংলায় জীবনীসাহিত্য  রচনার শ্রেষ্ঠ নজিরও স্থাপন করেছেন। ইতিমধ্যে এই জীবনীসাহিত্য ভারতের প্রতি ভাষায় যেমন প্রশংসিত হয়েছে তেমনি অনূদিত হয়েছে বিশ্বের প্রধান প্রধান ভাষাতেও। এখন একটা প্রচলিত ধারণা বদ্ধমূল হতে বসেছে যে, কথামৃত প্রথম প্রকাশিত হয় ইংরেজিতে। ১৮৯৭ সালে। প্রথমে ‘ব্রহ্মবাদিন’ পত্রিকায় পরে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ এবং অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রায় একই  সঙ্গে বইয়ের আকারে খণ্ডে খণ্ডে বের হতে থাকে মাদ্রাজ থেকে। যার নাম হয়  ‘গস্পেল অফ শ্রীরামকৃষ্ণ’। ব্র্যাকেটে লেখা থাকত ‘একরডিং টু এম।’ কেউ কেউ  দাবি করেন, ইংরেজিতে নয়, কথামৃত প্রথম বাংলাতেই বেরিয়েছিল। এখন যে আকারে  দেখি, সে আকারে হয়তো’ নয়, কিন্তু বাংলাতেই প্রথম এই বইয়ের আত্মপ্রকাশ  ঘটে। তা যদি না হবে, তাহলে ১৮৮৯ সালে ৭ ফেব্রুয়ারি নরেন্দ্রনাথ (স্বামী  বিবেকানন্দ) শ্রীমকে কেন লিখবেন—মাষ্টার আপনাকে লক্ষ লক্ষ ধন্যবাদ।  রামকৃষ্ণকে ঠিক পাকড়েছেন। 
নরেন্দ্রনাথ এ কথা সম্ভবত ‘শ্রীম’র দ্বারা সংগৃহীত রামকৃষ্ণের বাংলা  উপদেশের বিষয়ে করেছেন। কারণ তৎকালীন সমসাময়িক পত্রিকায় বলা  হয়—পরমহংসদেবের উক্তি, ৩য় ভাগ (ইং ১৮৯২/পৃ-২০) সচ্চিদানন্দ গীতরত্ন  দ্বারা প্রকাশিত। সাধু মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের কৃপায় ইহা সংগৃহীত হইল। সে  সময়কার আরেকটা পত্রিকা ‘অনুসন্ধানে’ বাংলা ১২৯৯ সনের ৩২ শ্রাবণ  মন্তব্যকার—পরমহংসদেবের উক্তি—মূল্য দুই আনা। এই পুস্তকের ভাষায় কিঞ্চিৎ দোষ থাকলেও পরম ভাগবত, পবিত্র চরিত্র পরমহংসদেবের উপদেশের গুণে ইহা সকলের  নিকট সমাদৃত হওয়া উচিত।
এই দুটি ঘটনা থেকে এমন কথা নিশ্চয়ই প্রমাণিত হয় যে, কথামৃত ছোট আকারে হলেও প্রথম বাংলাতেই আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমান আকারে কথামৃতের প্রথম ভাগ উদ্বোধন প্রেস থেকে ১৯০২ সালে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিপুলভাবে জনপ্রিয় হয় এই অমৃতসমান কথামৃত। ১৯৪৯ সালের মধ্যেই প্রকাশিত হয় প্রথম ভাগের ১৭ সংস্করণ। পরে এই সপ্তদশ সংস্করণ চোদ্দোটি পুনর্মুদ্রণ হয় ১৯৭৬ সালের মধ্যেই। অর্থাৎ কয়েক লক্ষ কপি প্রথম খণ্ড বিক্রি হয়ে যায় এরই মধ্যে। যতদিন যাচ্ছে, কথামৃতের জনপ্রিয়তা ততই বাড়ছে। ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে কথামৃত প্রথম ভাগের আরও তিনটি পুনর্মুদ্রণ হয়েছে। গড়ে বছরে একবার করে ছাপতে হচ্ছে।
এ তো গেল প্রথম ভাগের কথা। দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয় ১৯০৪ সালে। ১৯৮০  সালে ছাপা হয়েছে দ্বিতীয় ভাগের পঞ্চদশ সংস্করণ। ১৯০৮ সালে প্রকাশিত হয় তৃতীয় ভাগ। ১৯৭৮ সালে ছাপা হয়েছে তৃতীয় ভাগের ত্রয়োদশ সংস্করণ। ১৯১০  সালে প্রকাশিত হয় চতুর্থ ভাগ। ১৯৭৯ সালে তার ত্রয়োদশ সংস্করণ প্রকাশিত  হয়। আর সর্বশেষ পঞ্চম ভাগ প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালের জন্মাষ্টমীতে। তার মাত্র কয়েকদিন আগে (৪ জুন ১৯৩২) ৭৮ বছর বয়সে তিনি দেহত্যাগ করেন। 
লক্ষ্য  করার বিষয়, ১৯৭৯ সালের মধ্যে এই পঞ্চম ভাগেরও ত্রয়োদশ মুদ্রণ প্রকাশিত  হয়। এক এক সংস্করণের আবার একাধিক মুদ্রণও হয়েছে। সব মিলিয়ে এই পাঁচ ভাগ কথামৃত অর্ধভাগ বাঙালির ঘরে যে পরম আদরে স্থান পেয়েছে, সেটা সংখ্যাতত্ত্ব দিয়েই বিশ্লেষণ করা যায়। এমন জনপ্রিয় এবং এমন সর্বগ্রাসী ধর্ম সাহিত্য গ্রন্থ খুব কমই রয়েছে
কথামৃতের মূল পাণ্ডুলিপি এবং মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের অবশিষ্ট ডায়েরি  কোথায় তা নিয়ে এখনও সংশয় আছে। শোনা যায়, গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনের কথামৃত ভবনে সেগুলি রক্ষিত আছে। তবে অপ্রকাশিত ডায়েরির কিছু কিছু অংশ কোনো  কোনো গবেষকের কাছে আছে বলেও শুনেছি। কথামৃতকে পারিবারিক সম্পত্তি না করে এটাকে রামকৃষ্ণ মিশনের হাতে তুলে দেওয়ারও দাবি বারবার উঠেছিল। শ্রীময়ের যাবতীয় ডায়েরি এবং কাগজপত্রও রামকৃষ্ণ মিশনের হাতে দেওয়া হোক, বলেও বারবার দাবি উঠেছিল। যে কোনো কারণেই হোক সেটা আজ পর্যন্ত হয়নি। তাই এমন  অমূল্য ঐতিহাসিক দলিলের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা সম্পর্কেও অনেকের মনে আজ সন্দেহ  দেখা দিতে শুরু করেছে। ১৯৮২ সালে কথামৃতের গ্রন্থস্বত্ব অধিকার অবলুপ্ত  হয়েছে।
বাংলা কথামৃতের ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন স্বামী নিখিলানন্দ। এটি ১৯৪২ সালে নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয়। এই মহাগ্রন্থের ভূমিকা লিখতে গিয়ে মনীষী অল্‌ডাস হাক্সলি লিখছেন, এই প্রথম কোনো অবতার পুরুষের কথা, কোনো মহাপুরুষের কথা যেমন যেমনভাবে তিনি বলেছেন, সেইভাবে লিপিবদ্ধ হয়ে রইল।  শ্রীম যেমনভাবে শুনেছেন যা দেখেছেন হুবহু তাই লিখে রেখেছেন—নিজের এক কথাও  শ্রীরামকৃষ্ণের কথার সঙ্গে যোগ করেননি।
তাই বলে কথামৃতই শ্রীরামকৃষ্ণের পূর্ণাঙ্গ জীবনী নয়। ১৮৮২ সালের মার্চ থেকে ১৮৮৬ সালের এপ্রিল মোটামুটি এই চার বছরের পঞ্চাশটির বেশি কিছু দর্শনের বিবরণ এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে। তাছাড়া তিনি ছুটির দিনে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যেতেন। অন্য দিনের বিবরণ তিনি বিশেষ লেখেননি।  শ্রীরামকৃষ্ণ যখন তাঁর সন্ন্যাসী সন্তানদের উপদেশ দিতেন—তখন সেখানে কোনো  গৃহী সন্তানও থাকতেন না—যার পেটে যা সয়। তাই ঐসব বিবরণ কথামৃতে নেই। সেজন্যই কথামৃতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বামী সারদানন্দের শ্রীরামকৃষ্ণ  লীলাপ্রসঙ্গ।
কথামৃত রচনায় মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত কোন কোন উপকরণের ওপর নির্ভর করেছিলেন তা তিনি নিজেই জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘শ্রীম নিজে যেদিন ঠাকুরের কাছে  বসিয়া যাহা দেখিয়াছিলেন ও তাঁহার শ্রীমুখে শুনিয়াছিলেন, তিনি সেইদিন  রাত্রেই (বা দিবাভাগে) সেইগুলি স্মরণ করিয়া দৈনন্দিন বিবরণে Diary-তে  লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন। এই জাতীয় উপকরণ প্রত্যক্ষ (Direct) দর্শন ও  শ্রবণদ্বারা প্রাপ্ত, বর্ষ, তারিখ, বার, তিথি সমেত।….শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ  কথামৃত প্রণয়নকালে শ্রীম….. (এই) জাতীয় উপকরণের উপর নির্ভর করিয়াছেন’।  (কথামৃত ১ম, ভূমিকা)
এই ঘটনাই প্রমাণ করেছে, একজন ধর্মনায়কের কথা হুবুহু সঠিকভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে ব্যাকরণের অসঙ্গতি থাকতে পারে, কিন্তু যা বলা হয়েছে, তাই লিখা হয়েছে।
অবশ্য কথামৃতের আগেও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় শ্রীরামকৃষ্ণের কথা প্রকাশিত হয়েছে। এইসব পত্রপত্রিকার মধ্যে কতকগুলি ছিল হিন্দু রক্ষণশীল, কতকগুলি বৈষ্ণব বা ব্রাহ্ম সমাজের। বাংলা ১৩১১ সালে প্রবাসীতেও কথামৃত বেরিয়েছে। সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশিত রচনাগুলি সংকলন করে কথামৃত ১ম খণ্ড প্রকাশিত হয়, উদ্বোধন থেকে প্রকাশ করেন স্বামী ত্রিমুখাতিত। এটা ইংরেজি ১৯০২ সালের মার্চ মাসের ঘটনা, বাংলা ১৩০৮ সালের ফাল্গুন মাস। মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের আগে যাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণের কথাগুলিকে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছিলেন তাঁদের সঙ্গে  শ্রীম কথিত কথামৃতের তুলনা করলেই বোঝা যাবে মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত কত বড়ো প্রতিভাবান পুরুষ ছিলেন। অন্যান্যরা শ্রীরামকৃষ্ণের বক্তব্যকে মোটামুটি তুলে ধরতে পেরেই খুশি। আর শ্রীম তুলে ধরেছেন একেবারে তাঁর মুখের কথাকে—টানে ভঙ্গির সঙ্গে। 
কথামৃত নাম শ্রীম ব্যবহার করেছিলেন কেন? কথামৃত কথাকারই তাঁর গ্রন্থের প্রথম খণ্ড, প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় উদ্ধৃত করেছিলেন ভক্তি বিনম্র বৈষ্ণবদের নিত্য উচ্চারিত এক শ্লোক—
‘তব কথামৃতং তপ্ত জীবনং কবিভিড়ীতং কন্মষাপহম। শ্রবণ মঙ্গলং শ্রীমদ্যততং ভূবি গৃণান্তি যে ভূরিদাজনাঃ।।’ - শ্রীমদ্ভাগবত, গোপী গীতা।
শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে শ্রীম নিজেই যে কতটা জোর দিয়েছিলেন,  তা কথামৃত গ্রন্থের ভূমিকায় তাঁর স্বীকৃতি আছে—‘শ্রীম নিজে যেদিন ঠাকুরের  কাছে বসিয়া যাহা দেখিয়াছিলেন ও তাঁহার শ্রীমুখে শুনিয়াছিলেন, তিনি  সেইদিন রাত্রেই বা দিবাভাগে সেইগুলি স্মরণ করিয়া দৈনন্দিন বিবরণে Diary-তে  লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন। এই জাতীয উপকরণ—প্রত্যক্ষ (Direct), দর্শন ও শ্রবণ  দ্বারা প্রাপ্ত, বর্ষ, তারিখ, বার, তিথি সমেত।’
এক বিস্ময়কর মহাজীবন এবং তার অমৃতসমান বাণীই যদি কথামৃতের বিষয় হয়—তাহলে যে কথামৃতের সঙ্গে আমরা পরিচিত, তার অনুরূপ বা তুলনীয় কিছু শ্রীরামকৃষ্ণ বাণী ও প্রসঙ্গকথা আগেই প্রকাশিত হয়েছে এবং তা হয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবদ্দশাতেই।
প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণ কথা ও প্রসঙ্গের প্রকাশ ১৮৭৫ সালে ইংরেজি ভাষায়  ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকায়; এবং একই সালে বাংলা ভাষায ‘ধর্মতত্ত্ব’  পত্রিকায়। স্মরণে রাখা প্রযোজন, তখনও নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ হয়নি। তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ ১৮৮১ সালে।
‘ইন্ডিয়ান মিরর’-এর পরই প্রতাপচন্দ্র মজুমদার এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন,  যার মূল আলোচ্য ছিল—শ্রীরামকৃষ্ণ কথাকার ও তাঁর কথামৃত। এটি প্রকাশিত হয়  ‘সানডে মিরর’ পত্রিকায় (১৮৭৬)। অবশ্য এগুলি সবই খণ্ডচিত্র, পূর্ণচিত্র নয়।
অনুরূপ বিষয় নিয়ে নিবন্ধ-প্রবন্ধ এর পরে যা প্রকাশিত হয় সেগুলি  কালানুক্রমিক দিক দিয়ে—ধর্মতত্ত্ব (১৮৭৯), New Dispensation (১৮৮১-৮২),  সুলভ সমাচার (১৮৮১), ইন্ডিয়ান মিরর (১৮৮১/৮৪/৮৬), ধর্মতত্ত্ব (১৮৮৪),  পরিচারিকা (১৮৮৬)।
যদিও শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী এবং তাঁর কথামৃত ছিল সবগুলি নিবন্ধেরই বিষয়, তবুও এগুলি সবই ছিল পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ সুগ্রথিত ও সুবিন্যস্ত  গ্রন্থের গ্রন্থিতে কোনো পূর্ণ ‘কথামৃত’ নয়।
সেদিক থেকে বিচার করলে গ্রন্থ হিসেবে প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণ উক্তির—‘পরমহংস  উক্তি’র গ্রন্থকার কেশবচন্দ্র সেন, প্রকাশক ব্রাহ্ম সমাজ, প্রকাশকাল  ২৪/১/১৮৭৮, পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০। গ্রন্থাকারে হলেও এটাও পূর্ণাঙ্গ প্রয়াস নয়।
এরকমই আরেক ব্যাপকতর পরিসরে গ্রন্থ প্রকাশিত হলো, গ্রন্থটির নাম ‘পরমহংস রামকৃষ্ণের উক্তি’, গ্রন্থকার সুরেশচন্দ্র দত্ত, প্রকাশকাল ২৩/১২/১৮৮৪। বই জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাই এরই দ্বিতীয় খণ্ড বের হলো ১৮৮৬ সালে। সংযুক্ত খণ্ড বের হলো শ্রীরামকৃষ্ণের দুটি ছবি ও জীবনী যুক্ত হয়ে, ১৮৯৪ সালে। এই  গ্রন্থই খ্যাতনামা কথামৃতের আদিরূপ, যদিও তা পূর্ণ পরিণত রূপ নয়।
শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোধানের পরও ‘শ্রীম’ কথিত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’  জনসমক্ষে গ্রন্থ-আকারে প্রকাশ হতে দীর্ঘকাল লেগেছিল। ১৮৮৬ থেকে ১৯০১ এক  যুগেরও বেশি। কেন এতটা সময়ের ব্যবধান, সে সম্পর্কেও কোনো তথ্যনির্ভর সূত্র আমাদের হাতের কাছে নেই।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, শ্রীরামকৃষ্ণের জীবদ্দশাতেই শুধু নয়, তাঁর  তিরোধানের পরও এবং আমাদের আলোচ্য কথামৃতের প্রকাশ ঘটার আগে, ঠিক কথামৃতের অনুরূপ বিষয়বস্তু অবলম্বন করে আরও কয়েকটি ছোটো বড়ো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে সেরকম কয়েকটির উল্লেখ করা হলো—ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের  ‘পরমহংসদেবের উক্তি ও তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী’ (২৪/১/১৮৮৭), অক্ষয়কুমার  সেনের ‘পদ্যে শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশ’ (১৮৯৬), সত্যচরণ মিত্রের ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস জীবনী ও উপদেশ’ (১৮৯৭)—এ হলো মোটামুটি কথামৃতের  প্রদীপ জ্বলার আগে সলতে পাকানোর ইতিহাস।

এবার আমরা সংক্ষেপে শ্রীম সম্পর্কে কয়েকটি কথা জেনে নিতে পারি।
‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’-এর লেখক মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, যিনি ‘শ্রীম’  ছদ্মনামে বেশি পরিচিত, রামকৃষ্ণ পরিমণ্ডলে যিনি ‘মাস্টার মহাশয়’—তাঁর জন্ম ১৮৫৪ সালের ১৪ জুলাই আর মহাপ্রয়াণ ১৯৩২ সালের ৪ জুন। অর্থাৎ মোট ৭৮ বছর  তিনি এই পৃথিবীতে ছিলেন। তাঁর এই মহাজীবনকে আমরা দু-ভাগে ভাগ করতে  পারি—শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে এবং দেখা হওয়ার পরে।
নগেন্দ্রনাথ গুপ্তের কাছে শ্রীরামকৃষ্ণের কথা শুনে শ্রীম দক্ষিণেশ্বরে  হাজির হন। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হয় দক্ষিণেশ্বরেই ১৮৮২  সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৮ বছর। আর  শ্রীরামকৃষ্ণ-মহাজীবনের শেষ পর্ব তখন। এই ১৮৮২ থেকে ১৯৩২—তিনি ছিলেন রামকৃষ্ণময়। এই পঞ্চাশ বছরই তাঁর জীবনকে উদ্ভাসিত করেছে এক নতুন আলোয়।  রামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ ভক্তদের মধ্যে শিক্ষার মানদণ্ডে তিনি ছিলেন অগ্রণী। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় হয়েছিলেন। এম.এ পরীক্ষায় হয়েছিলেন পঞ্চম আর বি.এ পরীক্ষায় তৃতীয়। অধ্যাপনা করেছেন  রিপন, সিটি ও মেট্রোপলিটন কলেজে, পড়িয়েছেন ইংরেজি, ইতিহাস, মনোবিজ্ঞান ও  অর্থনীতি। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে প্রথম যখন দেখা হয় তখন তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত শ্যামপুকুর ব্রাঞ্চ ইস্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং ঝামাপুকুর মর্টন ইনস্টিটিউশনের পরিচালক। শ্রীম ছিলেন সংসারী মানুষ। নিয়মিত  শ্রীরামকৃষ্ণের আনন্দ-সভায় যোগ দিতে পারতেন না। ছুটির দিনেই বেশি গিয়েছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখার আগে পর্যন্ত ব্রাহ্ম সমাজের নায়ক কেশবচন্দ্র সেন  ছিলেন তাঁর কাছে আদর্শ পুরুষ। তিনি বিয়েও করেছিলেন কেশবচন্দ্রের পরিবারেরই এক কন্যাকে। বস্তুত কেশবচন্দ্র সেন তাঁর কাছে ‘দেবতার রূপ’ ধারণ করেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের বিবরণ কথামৃতেই আছে। সুতরাং এ ব্যাপারে নতুন করে বলার কিছু নেই। তিনি ছিলেন গৃহী। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে ঘ  থেকে টেনে এনে সন্ন্যাসের পথে ঠেলে দেননি। মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের কোনো কোনো  জীবনীকার লিখেছেন, তিনি ঘরেই থাকতেন—কিন্তু গবাক্ষপথে দেখতেন অনন্তকে।  আশ্রয়ের মধ্যে নিরাশ্রয়ের সাধনা করতেন।
তাই মাঝে মাঝে মধ্য রাত্রে যখন গোটা শহর ঘুমিয়ে পড়ত, চারদিকে নেমে আসত রহস্যময় নীরবতা তখন তিনি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেন হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতেন সেনেট হলের খোলা বারান্দায়। সেখানে আশ্রয়হীন ভিক্ষুকদের সঙ্গে রাত্রি যাপন করতেন। আবার ভাবতেন, আমি একা এই পৃথিবীতে। তিনি চলে যেতেন গঙ্গাতীরে, ঈশ্বর-জ্যোতি দেখার জন্য তাকিয়ে থাকতেন সাধুদের দিকে। আবার  তীর্থযাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করতেন, তাদের মুখে কোথায় লেখা আছে আনন্দের বার্তা।

শ্রীম যে কথামৃত বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছেন তাঁর উৎস হচ্ছে  মহেন্দ্রনাথের ডায়েরি। তিনি নিয়মিত ডায়েরি রাখতেন। কিন্তু কেন? তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘সংসারে জড়িয়ে আছি, কাজে বাঁধা, ইচ্ছামতো ঠাকুরের কাছে যেতে পারি না। তাই তাঁর কথাগুলো টুকে রাখতাম, কোন্ ভাব ও পরিবেশ সৃষ্টি করতেন তাও, যাতে করে পরবর্তী সাক্ষাতের আগে পর্যন্ত ঐসব কথা নিয়ে ভাবতে পারি, যেন সাংসারিক কাজকর্ম মনকে একেবারে গ্রাস করে না ফেলে। সুতরাং প্রথমত আমি নিজের উপকারের জন্যই নোটগুলি করেছিলাম’। 
স্বামী গম্ভীরানন্দ মাস্টার মহাশয়ের আর এক স্বীকারোক্তি উদ্ধৃত করেছেন, ‘আমার ছেলেবেলা থেকে ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল। যখন যেখানে ভাল বক্তৃতা বা ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ শুনতাম,  তখনই বিশেষভাবে লিখে রাখতুম। সেই অভ্যাসের ফলে ঠাকুরের সঙ্গে যেদিন যা  কথাবার্তা হত, বার-তিথি-নক্ষত্র-তারিখ দিয়ে লিখে রাখতুম’।
কথামৃতের মাধ্যমে বাংলাদেশের অনেক নামকরা মানুষই আজ বঙ্গজনের কাছে জীবন্ত হয়ে বারবার দেখা দেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথাই ধরা যেতে পারে। এত বড়ো মাপের মানুষ ব্যক্তিজীবনে কেমন ছিলেন, তাঁর কথাবার্তা কেমন ছিল, কেমন ছিল তাঁর ঘরদোর—এসবই আমাদের অজানা থেকে যেত, যদি না শ্রীম সেসব বিবরণ কথামৃতের পাতায় নিপুণভাবে পরিবেশন করতেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ গিয়েছিলেন বিদ্যাসাগরের বাড়িতে দেখা করতে সঙ্গে ছিলেন  শ্রীম। সে দিন ছিল ১৮৮২ সালের ৫ আগস্ট। এরকম দু-জন মানুষের মিলন এক ঐতিহাসিক ঘটনা। আর সেই ঘটনাকে ধারণ করে রেখেছে কথামৃত। সে দিক থেকে বিচার করলে কথামৃত বাংলার ধর্ম-সংস্কৃতি-সমাজজীবনের এক প্রত্যক্ষ দলিল। এক জীবন্ত  ইতিহাস।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আজ  শুধুই রবীন্দ্রনাথের পিতা হিসেবে বাংলা ও বাঙালির কাছে বেঁচে থাকতেন।  নির্মম হলেও এটাই সত্য। অথচ, কথামৃতের দৌলতে তিনি আজও জীবন্ত সত্তায় বেঁচে  আছেন, যেমন বেঁচে আছেন মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ব্রাহ্মনায়ক কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী এবং এরকম আরও অনেকেই।
কলকাতার চিড়িয়াখানা, যাদুঘর, এশিয়াটিক সোসাইটি, গড়ের মাঠ—সেকালের এইসব খণ্ড চিত্র কথামৃত অক্ষয় করে রেখেছে। সমকালের ইতিবৃত্তকে কথামৃত  চিরকালের ইতিহাসে রূপান্তরিত করেছে। সেইজন্যই কথামৃতের কোনও তুলনা নেই।

মূল লেখা: প্রণবেশ চক্রবর্তী।

 

মূলগ্রন্থে ডাউনলোড লিংক: https://drive.google.com/file/d/1PTNTa4BOq8gfC4OIjpW-FfBrG9r1l2Lc/view?usp=sharing

#রামকৃষ্ণ #কথামৃত

🌻🌼♥️🙏 জয় ঠাকুর মা স্বামীজী 🙏♥️🌼🌻 

মানসপুত্র নেতাজী

 🌿 মানসপুত্র নেতাজী 🍁 🌻১৯০২ সালের জানুয়ারীতে সুভাষচন্দ্রের পিতা তাঁকে কটকের মিশনারী স্কুলে ভর্তি করে দিলেন, পুত্রের প্রাথমিক বিদ্যা লাভে...