শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা ☸️🙏♥️🏵️💐
আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে আজকের দিনে এক আশ্চর্য মানুষ জন্মেছিলেন।
তখন ভারতবর্ষের ধর্মাকাশে এক ক্রান্তির সময়। বৈদিক যাগযজ্ঞের উদ্দেশ্য ও বিধেয় নিয়ে বৈশ্য ও শূদ্রদের মনে নানা প্রশ্ন জেগেছে। তাঁদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধছে৷ ব্রাহ্মণরা করের আওতার বাইরে, আর ক্ষত্রিয়রা দেশশাসক, স্বয়ং কর সংগ্রাহক। ফলে দেশের অর্থনীতির জোয়াল বৈশ্য এবং শূদ্রদের কাঁধে। তাঁরা এই ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। সেই প্রশ্ন ক্ষত্রিয়রা যে বুঝতে পারছেন না তা নয়, তাঁরাও বৈদিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের যাগযজ্ঞ এবং পশুবলির অসারতা অনুভব করতে পারছেন, কিন্তু কোনও সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছেন না। তাঁরা যুক্তির সোপানে পা রেখেছেন, কিন্তু ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের নিগড় ছেড়ে বেরোতে সাহস পাচ্ছেন না। কারণ তাঁরাও এতদিন ধরে বৈশ্যদের থেকে কর আদায় করেছেন, শূদ্রদের থেকে নিঃশুল্ক শ্রম। সেই জন্য এই দুই শ্রেণীর সমর্থনও তাঁদের আয়ত্বের বাইরে।
ঠিক এই সময়েই কপিলাবস্তু'র লুম্বিনী উদ্যান আলো করে নেমে এলেন এমন এক মানুষ যিনি যাগযজ্ঞ পশুবলি মন্ত্র তন্ত্র, যুদ্ধবিগ্রহ বা পরধর্মনিপীড়ন নয়, আত্মশক্তিকেই মুক্তির একমাত্র সোপান বলে চিহ্নিত করেছিলেন। যিনি করুণাঘন হৃদয়ে উচ্চারণ করেছিলেন "সব্বে সত্তা সুখিতা হোন্তু, অবেরা হোন্তু, অব্যাপজ্ঝা হোন্তু, সুখী অত্তানং পরিহরন্তু, সব্বে সত্তা মা যথালব্ধসম্পত্তিতো বিগচ্ছন্তু। সকল প্রাণী সুখিত হোক, শত্রুহীন হোক, সুখী অহিংসিত হোক, সুখী আত্মা হয়ে কালহরণ করুক। সকল প্রাণী আপন যথালব্ধসম্পত্তি হতে বঞ্চিত না হোক।" তাঁর সেই বোধি ও প্রজ্ঞার আলোকে এই চরাচর আজও আলোকময় হয়ে আছে।।
কিন্তু সেই বোধিলাভের মাহেন্দ্রক্ষণ এমনি এমনি আসেনি। এই একই তিথিতে ঘটেছিল আরও এক আশ্চর্য ঘটনা। সেই কথাই আপনাদের বলবো।
সেদিনও ছিলো এমনই এক স্নিগ্ধ শ্যামল সন্ধ্যা। গোপকন্যা সুজাতার দেওয়া পায়সান্ন গ্রহণ করে শাক্যসিংহ সিদ্ধার্থ বোধিদ্রুমের ছায়ায় নরম ঘাসে বোনা আসটিতে বসে সাধনায় দৃঢ়সংকল্প হলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, জগতের হিতের পথ না জেনে, নিপীড়িত লাঞ্ছিত মানুষের মুক্তির ইশারা না চিনে এই সাধনা থেকে প্রত্যাবৃত্ত হবেন না,
ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং
ত্বগস্থি মাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু।
অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্পদুর্লভাং
নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে॥
[এই আসনে আমার শরীর শুকিয়ে গেলে যাক, ত্বক, অস্থি, মাংস, ধ্বংস হলে হোক, তবুও বহুকল্পদুর্লভ বোধিলাভ না করে আমার দেহ এই আসন থেকে উঠবে না।]
আকাশ থেকে বজ্রের মতো, পাতাল থেকে অভিশাপের মতো, অন্ধকার থেকে দৈত্যের মতো ধেয়ে এলেন মার। সঙ্গে এলো বিভ্রম, হর্ষ ও দর্প আর রতি, আরতি ও তৃষ্ণা। তারা মারের তিনপুত্র, তিন কন্যা। তারা থাকে মানুষের মনের গহীন অন্ধকারে, ভোগে, কামনায়। পাপের পাতালে তাদের বাস, প্রলোভনের বাসনায় তাদের সিদ্ধি। কিন্তু যে অমিতপ্রভ শাক্যসিংহ আজ বুদ্ধ হবার জন্য দৃঢ়চিত্ত হয়েছেন, সামান্য মানুষীর কামনার সাধ্য কি তাঁর সামনে দাঁড়ায়?
মেরু পৰ্ব্বতরাজ স্থানতু চলেৎ সৰ্ব্বং জগন্নোভবৎ
সৰ্ব্বে তারকসঙ্ঘ ভূমি প্রপেতৎ সজ্যোতিষেন্দ্রা নভাৎ।
সৰ্ব্বে সত্ত্ব করেয় একমতয়ঃ শুষ্যেন্মহাসাগরো
নত্বেব দ্রুমরাজ মূলোপগতশ্চাল্যেত অস্মদ্বিধঃ।।
[যদি পৰ্ব্বতরাজ মেরু স্থানচ্যুত হয়, সমস্ত জগৎ শূন্যে মিশে যায়, সূর্যের সঙ্গে সমস্ত নক্ষত্রপুঞ্জ আকাশ থেকে ভূমিতে পতিত হয়, বিশ্বের সকল জীব একমত হয়, মহাসমুদ্র শুকিয়ে যায়, তবুও আমাকে এই বোধিবৃক্ষের আসন থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত করতে পারবে না]
অবশেষে স্বয়ং মার স্বয়ং অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে, সসৈন্যে সিদ্ধার্থের সঙ্গে বজ্রসংগ্রামে প্রবৃত্ত হলেন।কিন্তু বৃথা চেষ্টা।বহুতর ভয়, ক্রোধ, প্রলোভন, কুতর্কের পর মার পরাস্ত হলেন। তিনি সিদ্ধার্থের সাধনায় বিন্দুমাত্র বিঘ্ন ঘটাতে পারলেন না
সৰ্ব্বেয়ং ত্রিসহস্র মেদিনী যদিমারৈঃ প্রপূর্ণা ভবেৎ
সৰ্ব্বেষাং যথ মেরু পৰ্ব্বতবরঃ পাণীষু খড়্গো ভবেৎ।
তে মহ্যং ন সমর্থ লোম চালিতুং প্রাগেব মাং যাতিতুং
কুৰ্য্যাচ্চাপি হি বিগ্রহে স্ম বৰ্ম্মিতেন দৃঢ়॥
[এই তিন সহস্র ভূমি যদি মারে পরিপূর্ণ হয়, প্রত্যেক মারের খড়্গ যদি পর্বতশ্রেষ্ঠ সুমেরুর মতো বিশাল হয়, তবুও সাধনার সুদৃঢ় বর্মে আচ্ছাদিত আমাকে পরাস্ত করা দূরে থাকুক, মার আমাকে একবিন্দু বিচ্যুত করতে পারবে না।]
মারকে জয় করে সিদ্ধার্থ বুদ্ধত্বলাভে প্রবৃত্ত হলেন। রাত্রির প্রথম যামে তাঁর দিব্যচক্ষু জাগ্রত হলো। দ্বিতীয় যামে তিনি জাতিস্মর জ্ঞান বা পূর্বজন্মের বিষয় জ্ঞাত হলেন। তৃতীয় যামে জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুর উৎপত্তির বিষয়ে অবগত হলেন। অবশেষে তিনি উপলব্ধি করলেন চার আর্যসত্য, অবহিত হলেন অষ্টাঙ্গিক মার্গ সম্পর্কে। সিদ্ধার্থ সম্যক সম্বুদ্ধ হলেন, গৌতম বুদ্ধ হলেন।
আজ সেই দিন। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে পৃথিবীর জন্য খুলে গেছিলো অমৃতের অযুত দ্বার। নিজের অধ্যবসায়ে, ত্যাগে, করুণায়, তিতিক্ষায় রাজপুত্র সিদ্ধার্থ একজন সাধারণ মানুষ থেকে মহামানব বুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তপস্যার আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন,
অপরূপা তেসং অমতস্য দ্বারা
যে সোতবন্তো পমুঞ্চন্তু সদ্ধং,
বিহিঞ্চ সঞঞী পগুণং ন ভাসিং,
ধম্মং পণীতং মনুজেসু ব্রহ্মে।।
[অমৃতের দ্বার আজ উন্মুক্ত। যারা শুনতে পারো তারা শোনো। শ্রদ্ধাদ্বারাই এই অমৃতের সাক্ষাৎ লাভ হবে। হিংসা অপগুণ থেকে মুক্ত হও। ধর্ম এইভাবেই মানুষকে সার্থক করে]
তিনি বুদ্ধত্ব অর্জন করে তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন, "চরথ ভিক্খবে চারিকং বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়’—ভিক্ষুগণ, বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য, লোকের প্রতি পরম অনুকম্পা পরবশ হয়ে দিকে দিকে এই কল্যাণ ধর্ম প্রচার কর।" তাঁর শেষ উপদেশ ছিলো "আত্মদীপ ভব, আত্মশরণ ভব, অনন্যশরণ ভব, নিজেই নিজের প্রদীপ হও।"
জগতের সেই শ্রেষ্ঠ মহামানব, ভগবান তথাগত'র আজ আবির্ভাব দিবস। এই বৈশাখী পূর্ণিমার দিনেই তিনি মারকে জয় করে বুদ্ধ হন৷ আবার এই তিথিতেই তিনি সিংহশয়ানে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। মানুষকে বলেছেন ভয়হীন হতে, দ্বেষহীন হতে, ভেদবুদ্ধিহীন হতে। অক্রোধের দ্বারা ক্রোধকে জয় করার কথা বলেছেন, শ্রদ্ধাদ্বারা করুণার মন্দিরে অর্ঘ্যদানের কথা বলেছেন।বাঙালী কবি তাঁকে প্রণাম জানিয়ে লিখেছেন, "উদিল যেখানে বুদ্ধ-আত্মা মুক্ত করিতে মোক্ষ দ্বার ; আজিও জুড়িয়া অর্ধজগৎ ভক্তি-প্ৰণত চরণে যাঁর।"
ভারতের যা কিছু পুন্য, যা কিছু শুভ, যা কিছু মাঙ্গলিক, তার মূর্ত প্রতীক ওই একজনই, পরমকারুণিক তথাগত, ভগবান বুদ্ধ। আজও তিনি আমাদের জাগ্রত চৈতন্য, ভারতবর্ষের অন্তরাত্মা।
শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা🙏♥️🏵️💐
জয় ঠাকুর মা স্বামীজী 🙏♥️🏵️💐
No comments:
Post a Comment