স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু!
স্বামীজী লিখেছেন, প্রত্যেক জীব শক্তি প্রকাশের এক – একটি কেন্দ্র। পূর্বের কর্মফলে সে শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে, আমরা তাই নিয়ে জন্মেছি।
প্রণম্য গবেষক শঙ্করীপ্রসাদ বসু তাঁর সুভাষচন্দ্র বিষয়ক গবেষণাগ্রন্থে বলেছেন — তিনি সেই ক্ষণজন্মা পুরুষ, যিনি প্রথম জীবনে মোক্ষমার্গের অনুসারী পরে তাকে ত্যাগ করে পরিণত যৌবন থেকে — ভারতীয় ইতিহাসে ধর্মমার্গী মহাবীর অর্জুনের ভূমিকা নিয়েছিলেন।
তাঁর কাছে ভারতের ধর্মক্ষেত্র – কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণের ভূমিকা নিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
স্বামীজীর ত্যাগের মন্ত্রে সুভাষের জীবন উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল যুবা বয়সেই।
কলেজে পড়তে পড়তেই মনে তোলপাড় আকুতি — আর নয়, এবার বেরিয়ে পড়তে হবে গুরুর সন্ধানে — তাঁর বয়স তখন ১৭ বছর। তখন একটা অভাবিত ঘটনা ঘটে তাঁর জীবনে।
দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় যুবক এসেছিলেন কটকে। সুভাষ একদিন গেলেন তাঁর কাছে।
যুবকটি ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের ভক্ত। তাঁর টেবিলে রাখা ছিল বিবেকানন্দের লেখা অনেকগুলি বই। সুভাষ বইগুলি পড়তে শুরু করলেন — এক নতুন দিগন্ত খুলে গেল তাঁর সামনে।
ধর্মে ধর্মে কোনও ভেদ নেই;
দয়া নয় সেবা, ত্যাগ, ব্রহ্মচর্য।
দরিদ্র অবহেলিত মানুষের সেবাই যে পরম কর্তব্য, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ রইল না তাঁর।
সন্ন্যাসী হওয়ার বাসনা — প্রবল হয়ে উঠল তাঁর মনে। কিন্তু সন্ন্যাসী হতে গেলে প্রয়োজন একজন সদগুরুর।
তিনি শুনেছিলেন উত্তর-পশ্চিম ভারতে এমন সন্ন্যাসী আছেন, যাঁরা প্রকৃত পথের সন্ধান দিতে পারেন।
তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন, দু লাইনের লেখা একটি পোষ্টকার্ডে চিঠি দিয়ে।
উত্তর ভারতের সব কটি তীর্থ তিনি ঘুরলেন, সঙ্গে দু-জন বন্ধু ছিলেন। শুরু হল পরিব্রাজক সুভাষ চন্দ্রের হিমালয় যাত্রা। এ যেন স্বামী বিবেকানন্দের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই পরিব্রাজক বেশে আর একজন ভারত পথিকের তীর্থ যাত্রা।
লছমনঝোলা, হৃষিকেশ, হরিদ্বার, গয়া, মথুরা, বৃন্দাবন অনেক তীর্থে ঘুরলেন। বৃন্দাবন হয়ে সুভাষচন্দ্রেরা এলেন বারাণসীতে।
সেখানে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দুটি শাখাকেন্দ্র পাশাপাশি অবস্থান করছে।
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রথম সভাপতি ছিলেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ, যিনি শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয় রাখাল নামে পরিচিত, যাঁকে স্বামী বিবেকানন্দ ‘রাজা’ বলে ডাকতেন।
সুভাষচন্দ্র লিখেছেন, “বারানসীতে স্বামী ব্রহ্মানন্দ আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানালেন, তিনি আমার বাবা ও পরিবারের অনেককেই চিনতেন। এখানে আমরা কয়েকদিন রইলাম।”
সেই সময়ে একদিন নিজের মনোগত বাসনা প্রকাশ করে সুভাষ, স্বামী ব্রহ্মানন্দের কাছে সন্ন্যাস প্রার্থনা করেন।
সুভাষের প্রার্থনা শুনে স্বামী ব্রহ্মানন্দ সেই তরুণের তেজোদৃপ্ত মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে সম্ভবত অনাগত ভবিষ্যতের এক মহানায়কের আবির্ভাব লগ্নকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
এই ঘটনার অল্পদিন পরে, সুভাষচন্দ্রের দেশ সেবা তথা রাজনীতির প্রভাব দেখা যায়।
স্বামী ব্রহ্মানন্দের দর্শনে সুভাষচন্দ্র অপার শান্তি পেয়েছিলেন। তাঁর তৃষিত বুকে শান্তিবারিধারা নেমে এসেছিল।
বন্ধু দিলীপকুমার রায়ের দুহাত চেপে ধরে বললেন, “ঐ রাখাল মহারাজই আমাকে কাশী থেকে ফিরিয়ে পাঠান, বলেন, আমাকে দেশের কাজ করতে হবে।”
সন্ন্যাসজীবন নয়, অন্তরে বৈরাগী থেকে দেশের কাছে তাঁকে আত্মোৎসর্গ করতে হবে — এই ছিল সুভাষের প্রতি স্বামী ব্রহ্মানন্দের উপদেশ।
সুভাষচন্দ্রের অগ্রজ সুরেশচন্দ্র বসু স্বামী শঙ্করানন্দের মুখে শুনেছেন,
“একদিন বারাণসীর মিশন বাড়িতে স্বামী ব্রহ্মানন্দ যখন বসেছিলেন, তখন মহারাজ দেখতে পান একটি ছেলে এসে ঢুকলো। মহারাজ বললেন, জানকীবাবুর ছেলে মনে হচ্ছে। যদি তাই হয়, তবে ছেলেটির যেন যথাযথ দেখাশোনা করা হয়।
বিকেলবেলা মহারাজের কাছে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলে — তিনি তাঁকে গৃহে ফিরে যাওয়ার উপদেশ দেন এবং বলেন, — তাঁকে তাঁদের মত সন্ন্যাস নিতে হবে না। দেশ তাঁর কাছে প্রভূত জিনিস প্রত্যাশা করছে।”
স্বামীজীর বাণী তাঁর অন্তরে অগ্নির স্ফুলিঙ্গের মত সঞ্চার করেছিল প্রেরণা আর উদ্দীপনা।
স্বামী ব্রহ্মানন্দের অধ্যাত্মশক্তির কৃপা মনকে দিল শক্তি, ধ্যানসজ্জাত স্থিরলক্ষে অবিচলতা আর বৈরাগ্যের আদর্শ।
রাজা মহারাজের (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) যিনি বালক সুভাষচন্দ্রকে স্বদেশ সেবার পথনির্দেশ দিয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ হতে বিরত করেন ও অমোঘ আশীর্বাদে জীবন ভূষিত ও ধন্য করেন। সেই মহাপুরুষের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সুভাষচন্দ্র পরবর্তীকালে ভাববিহ্বল হয়ে বলেন যে যিনি আশীর্বাদ পেয়েছেন, তিনিই জানেন তাঁর যথার্থ। স্বদেশের মুক্তিকল্পে তাঁর যে সুদীর্ঘ পথপরিক্রমণ, ব্রহ্মানন্দ আশীষই তাঁর ছিল সর্বোচ্চ দিঙনির্দেশক।
অন্তরে যেন অনুরণিত হল, “কে তুমি বাজালে নবীন রাগেতে ভারতের প্রাণবীণা।”
স্বামী বিবেকানন্দেরই এক গুরুভাইয়ের নির্দেশে, সন্ন্যাস গ্রহণের সঙ্কল্প ত্যাগ করে ঘরে ফিরে এলেন —– সুভাষচন্দ্র।
সুভাষচন্দ্রের আজীবন এই আধ্যাত্মিক পিপাসাই তাঁকে স্বদেশমুক্তির বিশেষ কর্মযজ্ঞে প্রণোদিত করে ও বিবেকানন্দ-ব্রহ্মানন্দ নির্দেশিত পথে স্বীয় লক্ষের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে অনুপ্রাণিত করে।
এও এক অদ্ভুত যোগাযোগ! গতকাল ছিল ২৩শে জানুয়ারি... একজনের আবির্ভাব তিথি আর একজনের জন্মদিন। দুই মহামানবকে জানাই অন্তরের শ্রদ্ধা ও প্রণাম।🙏🙏🙏💐🏵🌸🌼