_________________________________
“বিভিন্ন দর্শনের তুলনায় দেখা যায়, হিন্দুদর্শনের প্রবণতা ধ্বংস করা নয়, বরং প্রত্যেক বিষয়ে সমন্বয় সাধন করা। যদি ভারতে নতুন কোন ভাব আসে আমরা তার বিরোধিতা করি না, বরং তাকে আত্মসাৎ করে নিই, অন্যান্য ভাবের সঙ্গে মিলিয়ে নিই... তাই আমরা কোন ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থকে প্রত্যাখ্যান করতে পারি না।... পৃথিবীর যেখানেই দেখবে অসাধারণ কোন পবিত্র মানব মানুষের উন্নতির জন্যে চেষ্টা করছেন, জেন—তাঁর মধ্যে ভগবানই রয়েছেন। অতএব বুঝতে পারছ, কেন আমরা কোন ধর্মের সঙ্গে লড়াই করি না। আমরা কখনও বলি না, আমাদের ধর্মই মুক্তির একমাত্র রাস্তা। যে-কোন মানুষ সিদ্ধাবস্থা লাভ করতে পারে—তার প্রমাণ? প্রত্যেক দেশেই দেখি পবিত্র সাধু পুরুষ রয়েছেন, আমার ধর্মে জন্মগ্রহণ করুন বা না করুন—সর্বত্র সদ্ভাভাবাপন্ন নরনারী দেখা যায়। অতএব বলা যায় না, আমার ধর্মই মুক্তির একমাত্র পথ। ‘অসংখ্য নদী যেমন বিভিন্ন পর্বত থেকে বেরিয়ে একই সমুদ্রে তাদের জলধারা মিশিয়ে দেয়, তেমনি বিভিন্ন ধর্ম বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্ভূত হয়ে তোমারই কাছে আসে’—এটি ভারতে ছোট ছেলেদের প্রতিদিনের একটি প্রার্থনার অংশ। যারা প্রতিদিন এই ধরনের প্রার্থনা করে, তাদের পক্ষে ধর্মের বিভিন্নতা নিয়ে মারামারি করা একেবারেই অসম্ভব।”
— স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা/পঞ্চম খণ্ড/ভারত-প্রসঙ্গে/হিন্দু ও খ্রীষ্টান/পৃষ্ঠাঃ ৩২২-৩২৩
ঐতিহ্য মেনে প্রতিবছরই ক্রিস্টমাস ইভে বেলুড় মঠ সহ রামকৃষ্ণ মিশনের সমস্ত শাখায় ভগবান যীশুখ্রীস্টের পুজো অনুষ্ঠিত হয়। এই নিয়ে অনেকের মনেই কিছু বিভ্রান্তি, কিছু প্রশ্ন দেখা যায়। কেন হয় রামকৃষ্ণ মিশনে যীশুপুজো? কবে থেকে চালু হয়েছিল? কে চালু করেছিলেন? স্বামী বিবেকানন্দের সাথে এই যীশুপুজোর কি কোন সম্পর্ক আছে? চার্চের খ্রীস্টমাস আর এই যীশুপুজো কি এক? আজ আমরা প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রশ্নগুলির উত্তর অনুসন্ধান করব।
রামকৃষ্ণ মিশনে ক্রিস্টমাস ইভে হওয়া এই যীশুপুজোর উৎস সন্ধানে আমাদের যেতে হবে স্বামী বিবেকানন্দের সন্ন্যাসজীবনের আদিপর্বে—যখন তিনি নরেন্দ্রনাথ দত্ত—স্বামী বিবেকানন্দ তো দূর, স্বামী বিবিদিষানন্দও হন নি। মহেন্দ্রনাথ দত্ত বরাহনগর মঠের সেই সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখছেন—
“এই সময় বাইবেল পড়া খুব চলিত। নরেন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রকে ও অপর সকলকে বাইবেল উপাখ্যান বলিতেন ও Nicodemus-এর উপাখ্যানটা সর্বদাই আবৃত্তি করিতেন। নরেন্দ্রনাথ কি এক মহাভাবে বিভোর হইয়া চক্ষু নিমীলিত করিয়া প্রায় এই কথাটি উচ্চারণ করিতেন, “Thou shalt be born again.” সময় অসময় Nicodemus-এর গল্পটি মুখে লাগিয়া থাকিত যীশু যেমন নিজের লইয়া একটা সঙ্ঘ করিয়াছিলেন এবং শিষ্যেরা যীশুর অন্তর্ধানের পর পরস্পরে প্রগাঢ় ভালবাসার সহিত একীভূত হইয়াছিলেন, নরেন্দ্রনাথও সেই দৃশ্যটি চোখে রাখিয়া আপনার অল্পবয়স্ক গুরুভাইদিগকে অজ্ঞাতভাবে শুনাইতে লাগিলেন। যীশুর জীবনটা যেন সেই সময় তাহার আদর্শ হইয়াছিল এবং শরৎ মহারাজেরও সেই ভাবটি তখন প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। হইবারই ত কথা। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের আত্মত্যাগ ও ভগবানের উপর নির্ভরতা, অমানুষিক ভালবাসা এবং অল্পবয়স্ক কতিপয় যুবক একত্রিত হইয়া মনপ্রাণ দিয়া ভগবান লাভের জন্য গুরুর শুশ্রূষা করিতেছে,—যীশুর সহিত এই অবস্থার সৌসাদৃশ্য খুবই হইয়াছিল। যীশুর ছবি আনিয়া দেওয়ালে রাখিতে লাগিলেন। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকে দেখিয়া যীশুর ভাব বুঝিতে লাগিলেন বা যীশুর বই পড়িয়া শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকে বুঝিতে লাগিলেন। একভাব অপর ভাবকে প্রক্ষুটত করিতে লাগিল। এই জন্যই নরেন্দ্রনাথের গল্পটি এমন ভাল লাগিত এবং নিতান্ত অনুগত শরৎচন্দ্রও সেই গল্পটি মনেপ্রাণে হৃদয়ঙ্গম করিতে লাগিলেন।”
— মহেন্দ্রনাথ দত্ত/শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজীর জীবনের ঘটনাবলী/প্রথম খণ্ড/নরেন্দ্রনাথের যীশুর ভাবে সাধন/পৃষ্ঠাঃ ২৮-২৯
মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা অন্যান্য বইতে এই সময় বরাহনগর মঠে, নরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং তাঁর গুরুভাইদের যীশুর ভাবে সাধনা করার বিস্তারিত বিবরণ আছে। এই অবস্থাতেই আরও একটি ঘটনা তাঁদের জীবনে ঘটে, যেটিকে রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য সন্ধিক্ষণ (Turning Point) বললেও বিন্দুমাত্র অত্যুক্তি করা হয়না। স্বামী বিবেকানন্দের সব জীবনীতেই সেই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আছে। তবে আমরা স্বামী প্রভানন্দের লেখা গবেষণা গ্রন্থ “রামকৃষ্ণ মঠের আদিকথা” থেকে এই বিষয়ে তথ্য নেব।
“এ সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। বাবুরাম-জননী মাতঙ্গিনী দেবীর আমন্ত্রণে নরেন্দ্র, তারক, শশী, কালী, বাবুরাম, শরৎ, নিরঞ্জন, গঙ্গাধর ও সারদা এই নয়জন আঁটপুরে উপস্থিত হয়েছিলেন ১৮৮৬ ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে। মাতঙ্গিনী দেবীর আদর-আপ্যায়নে তাদের দিন আনন্দে অতিবাহিত হয়। নির্জন গ্রামীণ পরিবেশে তাঁরা জপ-ধ্যান-ভজনে মেতে ওঠেন। মাঝে মধ্যে চলতে থাকে আমোদ-আহ্লাদ। সুযোগ পেলেই নরেন্দ্রনাথ গুরুভাইদের এক একজনকে বা একত্রে সকলকে শ্রীরামকৃষ্ণ- জীবনের তাৎপর্য ও তার ভবিষ্যভূমিকা সম্বন্ধে বলতে থাকেন। এক সন্ধ্যায় তরুণ ভক্তগণ একটি ধুনির চারদিকে শান্ত আকাশের নিচে বসে ধ্যান করতে থাকেন। ধ্যানান্তে সৎপ্রসঙ্গ করতে থাকেন নরেন্দ্রনাথ। তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠে উপস্থাপিত করেন যীশুখ্রীস্টের ত্যাগ ও বৈরাগ্যের জীবন। প্রসঙ্গক্রমে বলেন যীশু-শিষ্যদের তপস্যাপৃত জীবনগাথা, খ্রীস্টধর্ম-প্রচারে তাদের আত্মত্যাগের কথা। নরেন্দ্রনাথ যেন ভাবাবিষ্ট হয়ে গুরুভাইদের সামনে উন্মোচিত করেন রামকৃষ্ণ-মহিমার গৌরবোজ্জ্বল এক ভবিষ্যৎ। নেতা নরেন্দ্রনাথ আবেগের সঙ্গে আহ্বান করেন তাদের তন-মন-প্রাণ উৎসর্গ করার জন্য, তবেই শ্রীরামকৃষ্ণ-আবির্ভাব সার্থক হবে। উপস্থিত সকলের প্রাণে শিহরণ জাগে। তাঁরা সমবেতভাবে অগ্নিশিখাকে সাক্ষী রেখে সংসার-ত্যাগের চরম সংকল্প গ্রহণ করেন। পরে সে শুভক্ষণটি ভগবান যীশুর ‘আবির্ভাবের প্রাক-সন্ধ্যা’ জানতে পেরে সকলে বিস্মিত হন। এই ঘটনাটির গুরুত্ব নির্দেশিত করে তাপস তারকনাথ মন্তব্য করেছিলেন, ‘আঁটপুরেই আমাদের সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার সংকল্প দৃঢ় হলো। ঠাকুর তো আমাদের সন্ন্যাসী করে দিয়েছিলেনই—ঐ ভাব আরও পাকা হলো❤️🙏🏻🙏🏻❤️
🌻💮🙏🏻জয় ঠাকুর মা স্বামীজী 🙏🏻🏵️🌼
No comments:
Post a Comment