(শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব) (বাবা ত্রৈলঙ্গস্বামী)
🍁সালটা ১৮৬৮:-
শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর ভাগ্নে হৃদয়কে নিয়ে মথুরবাবুর সঙ্গে কাশীতে তীর্থ করতে এসেছেন। বিশ্বনাথ দর্শনের পর তিনি বললেন, ‘হৃদে চল, এ বার জীবন্ত বিশ্বনাথ দর্শন করে আসি’। হৃদে বলল, ‘জীবন্ত বিশ্বনাথ! তোমার মাথাটা এ বার সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে মামা’। শ্রীরামকৃষ্ণ একগাল হেসে বললেন, ‘আয় না রে পাগল... হাঁটা চলা করা, কথা বলা বিশ্বনাথ দেখবি চল’।
কাশীর মনিকর্ণিকা ঘাটে গিয়ে রামকৃষ্ণ দেখলেন, তাঁর জীবন্ত বিশ্বনাথ চোখ বুজে শুয়ে আছেন। রামকৃষ্ণ তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ধীরে ধীরে চোখ খুললেন মহাযোগী ত্রৈলঙ্গ স্বামী। সাগরের পথে চলতে চলতে দু’টি নদী যেন মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। অপলক দৃষ্টিতে দু’জন দু’জনকে দেখতে লাগলেন, অন্তরের গোপন ভাষায় তাঁরা কথা বললেন... এক মহাপুরুষ আর এক মহাপুরুষকে অনুভব করলেন চেতনার অনুভবে।
পরে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘ত্রৈলঙ্গ স্বামীই হলেন মানুষরূপী বিশ্বেশ্বর। আমি ইশারায় তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ঈশ্বর এক না অনেক? উনি ইশারায় আমাকে বলেছিলেন, সমাধিস্থ হয়ে দেখলে এক, না হলে যতক্ষণ আমি, তুমি, জীব, জগৎ ইত্যাদি নানা জ্ঞান রয়েছে, ততক্ষণ অনেক’।
কোনও শব্দ ব্যয় না করেই এই যে পারস্পরিক বোঝাপড়া, কোনও এক অন্তরের গোপন ভাষায়, তা তো সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়! তাই এই যোগাযোগ যেন অপার্থিব বলে মনে হয়।
শুধু শ্রীরামকৃষ্ণই নন, গৃহী-সন্ন্যাসী শ্যামাচরণ লাহিড়ী এবং প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সঙ্গে ত্রৈলঙ্গ স্বামীর সাক্ষাৎ-কাহিনিও একই রকম বিস্মিত করে আমাদের।
কী হয়েছিল?
এক দিন ত্রৈলঙ্গস্বামীর সঙ্গে দেখা করার জন্য কাশীর গঙ্গার তীরে তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শ্যামাচরণ লাহিড়ী। চোখ খুললেন বিশালবপু মহাযোগী। আর সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন শ্যামাচরণ। স্বামীর চোখ দুটোর ভিতর দিয়ে তিনি যেন সাক্ষী হয়ে রইলেন সমগ্র জগৎ সংসারের। ত্রৈলঙ্গ স্বামীও দু’চোখ ভরে দেখলেন তাঁকে। আবার চোখ বন্ধ করলেন। একটিও কথা বলেননি শ্যামাচরণ। শুধু মৃদু হেসে চলে গিয়েছিলেন সেখান থেকে।
পরে ত্রৈলঙ্গ স্বামী তাঁর ঘনিষ্ঠদের বলেছিলেন, ‘ওকে আর কী বলব? যোগমার্গের যে অবস্থায় পৌঁছে সাধক নির্দ্বিধায় তার লেংটিটাও ছুড়ে ফেলে দিতে পারে, বেটা ধুতি-পাঞ্জাবি পরেই সেই অবস্থায় অনেক দিন আগেই পৌঁছে গিয়েছে, ওকে আমার আর কিছু বলার নেই’।
শ্যামাচরণ লাহিড়ীর মতো এক দিন চমকে উঠেছিলেন প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীও। ত্রৈলঙ্গ স্বামীর সঙ্গে দেখা করবেন বলে অনেকদিন ধরেই তাঁকে অনুসরণ করছিলেন তিনি। সেই সময় স্বামী দিন-রাত গঙ্গার জলেই থাকতেন। সেখানেই তাঁর খাওয়া, শোয়া, বসা, ঘুমানো। জলস্রোতের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘুরে বেড়াতেন একঘাট থেকে অন্যঘাটে। আর বিজয়কৃষ্ণও তাঁকে অনুসরণ করে ছুটে বেড়াতেন গঙ্গার তীর ধরে। এ ভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন গঙ্গার ধারে এক কালীমন্দিরে বিজয়কৃষ্ণ দেখতে পেলেন ত্রৈলঙ্গ স্বামীকে। মন্দিরে ঢুকলেন। কিন্তু যে দৃশ্য দেখলেন তাতে স্তম্ভিত, রুদ্ধবাক হয়ে গেলেন তিনি। দেখলেন, কালীমূর্তির গায়ে নিজের প্রস্রাব ছিটিয়ে দিচ্ছেন ত্রৈলঙ্গস্বামী, নিজেও মাখছেন!
ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত বলে বিজয়কৃষ্ণ মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করতেন না ঠিকই, কিন্তু ত্রৈলঙ্গস্বামীর এই আচরণও মানতে পারলেন না। বিতৃষ্ণা গ্রাস করল তাঁকে। তিনি সেখান থেকে ফিরে গেলেন।
এর পর একদিন বিজয়কৃষ্ণের কাছে খবর এল, ত্রৈলঙ্গ স্বামী তাঁকে দীক্ষা দিতে চান। বিজয়কৃষ্ণ তাঁর কাছে গেলেন। স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট বললেন, ‘আমি আপনার কাছে দীক্ষা নেব না, আপনি কালী-মূর্তির গায়ে প্রস্রাব ছিটিয়ে দেন কেন? এমন অনাচারী মানুষের কাছে আমি দীক্ষা নেব না। তা ছাড়া আমি তো ব্রাহ্ম, আপনি আমাকে দীক্ষা দেবেন কী করে?’ এ কথা শুনে ছোট্ট বালকের মতো খিলখিল করে হেসে উঠলেন স্বামী। বললেন, ‘প্রস্রাব কোথায়! আমি তো গঙ্গাজল দিয়ে মায়ের পুজো করছিলাম। এই পৃথিবীর সব কিছুতেই ঈশ্বর আছেন, তাই এই পৃথিবীর সব কিছুই তাঁর পূজা-উপাচার। মনের চোখটাকে খুলে দিতে পারলেই সব কিছু একাকার হয়ে যায় রে... সব কিছু একাকার হয়ে যায়... যোগসাধনা দিয়েই সব একাকার করে নিতে হয় রে বেটা। শোন, আমি কারও গুরু নই, গুরু হতেও চাই না, তোর দেহ শুদ্ধিকরণের জন্য ঈশ্বরের আদেশে আমি তোকে দীক্ষা দিচ্ছি... তোর আসল গুরু তিনিই’। প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ বুঝতে পারলেন মহাযোগীর কথা। ভক্তিভরে দীক্ষা নিলেন তাঁর কাছ থেকে।
এর বেশ কিছুকাল পর, মহাযোগী হঠাৎ একদিন সবাইকে ডেকে বললেন, ‘আমার যাওয়ার সময় হয়েছে। এ বার আমি এই জীর্ণ শরীর ত্যাগ করব, তোরা আমাকে বিদায় দে...’। স্বামীজির এই অপ্রত্যাশিত, মর্মান্তিক সিদ্ধান্তে সবাই হতবাক হয়ে গেলেন। তাঁরা স্বামীকে অনেক অনুরোধ করলেন, চার দিকে কান্নার রোল উঠল, কিন্তু ত্রৈলঙ্গ স্বামীকে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে নড়ানো গেল না। শেষে সকলের অনুরোধে তিনি তাঁর দেহত্যাগের দিন একমাস পিছিয়ে দিলেন। এই একমাস ধরে গঙ্গার তীরে তাঁর একটি পাথরের মূর্তি তৈরি করা হল। নির্দিষ্ট দিনে সেই মূর্তির সামনেই মহাযোগী ত্রৈলঙ্গ স্বামী তাঁর জীর্ণ দেহ ছেড়ে চলে গেলেন অনন্তলোকে। আজও অগণিত ভক্ত বারাণসীর গঙ্গার ঘাটে ওই মূর্তিটিকেই মহাযোগী ত্রৈলঙ্গস্বামীর জীবন্ত সত্তা হিসেবে পুজো করেন, গঙ্গার জলে অঞ্জলি দেন তাঁর উদ্দেশে।
🙏🏻।।জয় গুরু।।🙏🏻
🌷।।হরি ওঁ শ্রীরামকৃষ্ণ।।🌷
(★এরকম পোষ্ট নিয়মিত পেতে ফেসবুক পেজটি ফলো করে রাখুন★)
দিব্যত্রয়ী - The Holy Trio
No comments:
Post a Comment