Tuesday, 17 December 2024

আমিষ নিরামিষ বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দ


 

⚜️আমিষ-নিরামিষ আহার বিষয়ে স্বামীজীর একটি সুন্দর আলোচনা:- ⚜️


শিষ্য -- স্বামীজী, খাদ্যাখাদ্যের সহিত ধর্মাচরণের কিছু সম্বন্ধ আছে কি?


স্বামীজী -- অল্পবিস্তর আছে বইকি।


শিষ্য -- মাছ-মাংস খাওয়া উচিত এবং আবশ্যক কি?


স্বামীজী -- খুব খাবি বাবা! তাতে যা পাপ হবে, তা আমার। তোদের দেশের লোকগুলোর দিকে একবার চেয়ে দেখ দেখি -- মুখে মলিনতার ছায়া, বুকে সাহস ও উদ্যম শূন্যতা, পেটটি বড়, হাতে পায়ে বল নেই, ভীরু ও কাপুরুষ!


শিষ্য -- মাছ-মাংস খাইলে যদি উপকারই হইবে, তবে বৌদ্ধ ও বৈষ্ণবধর্মে অহিংসাকে ‘পরমো ধর্মঃ” বলিয়াছে কেন?


স্বামীজী -- বৌদ্ধ ও বৈষ্ণবধর্ম আলাদা নয়। বৌদ্ধধর্ম মরে যাবার সময় হিন্দুধর্ম তার কতকগুলি নিয়ম নিজেদের ভেতরে ঢুকিয়ে আপনার করে নিয়েছিল। ঐ ধর্মই এখন ভারতবর্ষে বৈষ্ণবধর্ম বলে বিখ্যাত। 'অহিংসা পরমো ধর্মঃ' -- বৌদ্ধধর্মের এই মত খুব ভাল, তবে অধিকারী বিচার না করে বলপূর্বক রাজশাসনের দ্বারা ঐ মত জনসাধারণ সকলের উপর চালাতে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম দেশের মাথাটি একেবারে খেয়ে দিয়ে গেছে। ফলে হয়েছে এই যে, লোকে পিঁপড়েকে চিনি দিচ্ছে, আর টাকার জন্য ভায়ের সর্বনাশ করছে! অমন ‘বক-ধার্মিক' এ জীবনে অনেক দেখেছি। অন্যপক্ষে দেখ - বৈদিক ও মনুক্ত ধর্মে মৎস্য-মাংস খাবার বিধান রয়েছে, আবার অহিংসার কথাও আছে। অধিকারি-বিশেষে হিংসা ও অধিকারিবিশেষে অহিংসা-ধর্মপালনের ব্যবস্থা আছে। শ্রুতি বলছেন -- 'মা হিংস্যাৎ সর্বভূতানি'; মনুও বলেছেন -- 'নিবৃত্তিস্তু মহাফলা'।


শিষ্য -- কিন্তু এমন দেখিয়াছি মহাশয়, ধর্মের দিকে একটু ঝোঁক হইলেই লোক আগে মাছ-মাংস ছাড়িয়া দেয়। অনেকের চক্ষে ব্যভিচারাদি গুরুতর পাপ অপেক্ষাও যেন মাছ-মাংস খাওয়াটা বেশি পাপ! -- এ ভাবটা কোথা হইতে আসিল?


স্বামীজী -- কোত্থেকে এলো, তা জেনে তোর দরকার কি? তবে ঐ মত ঢুকে যে তোদের সমাজের ও দেশের সর্বনাশ সাধন করেছে, তা তো দেখতে পাচ্ছিস? দেখ না -- তোদের পূর্ববঙ্গের লোক খুব মাছ-মাংস খায়, কচ্ছপ খায়, তাই তারা পশ্চিম-বাঙলার লোকের চেয়ে সুস্থশরির। তোদের পূর্ববাক্ষলার বড় মানুষেরাও এখনো রাত্রে লুচি বা রুটি খেতে শেখেনি। তাই আমাদের দেশের লোকগুলোর মতো অম্বলের ব্যারামে ভোগে না। শুনেছি, পূর্ব- বাঙলার পাড়া গাঁয়ে লোকে অম্বলের ব্যারাম কাকে বলে, তা বুঝতেই পারে না।


শিষ্য -- আজ্ঞা হাঁ। আমাদের দেশে অম্বলের ব্যারাম বলিয়া কোন ব্যারাম নাই। এদেশে আসিয়া ঐ ব্যারামের নাম শুনিয়াছি। দেশে আমরা দুবেলাই মাছ-ভাত খাইয়া থাকি।


স্বামীজী -- তা খুব খাবি। ঘাসপাতা খেয়ে যত পেটরোগা বাবাজীর দলে দেশ ছেয়ে ফেলেছে। ও-সব সত্ত্বগুণের চিহ্ন নয়, মহা তমোগুণের ছায়া -- মৃত্যুর ছায়া। সত্ত্বগুণের চিহ্ন হচ্ছে -- মুখে উজ্জ্বলতা, হৃদয়ে অদম্য উৎসাহ, tremendous activity (প্রচন্ড কর্মতৎপরতা); আর তমোগুণের লক্ষণ হচ্ছে আলস্য, জড়তা, মোহ নিদ্রা -- এই সব।


শিষ্য -- কিন্তু মহাশয়, মাছ-মাংসে তো রজোগুণ বাড়ায়।


স্বামীজী -- আমি তো তাই চাই। একন রজোগুণেরই দরকার। দেশের যে-সব লোককে এখন সত্ত্বগুণী বলে মনে করছিস, চাদের ভেতর পনের আনা লোকই ঘোএ তমোভাবাপন্ন। এক আনা লোক সত্ত্বগুণী মেলে তো ঢের! এখন চাই প্রবল রজোগুণের তান্ডব উদ্দীপনা। দেশ যে ঘোর তমসাচ্ছন্ন, দেখতে পাচ্ছিস না? এখন দেশের লোককে মাছ-মাংস খাইয়ে উদ্যমী করে তুলতে হবে, জাগাতে হবে, কার্যতৎপর করতে হবে। নতুবা ক্রমে দেশসুদ্ধ লোক জড় হয়ে যাবে, গাছ-পাথরের মতো জড় হয়ে যাবে। তাই বলছিলুম, মাছ-মাংস খুব খাবি।


শিষ্য -- কিন্তু মহাশয়, মনে যখন সত্ত্বগুণের অত্যন্ত স্ফূর্তি হয়, তখন মাছ-মাংসে স্পৃহা থাকে কি?


স্বামীজী -- না, থাকে না। সত্ত্বগুণের যখন খুব বিকাশ হয়, তখন মাছ-মাংসে রুচি থাকে না। কিন্তু সত্ত্বগুণ- প্রকাশের এইসব লক্ষণ জানবি - পরের জন্য সর্বস্ব-পণ, কামিনী-কাঞ্চনে সম্পূর্ণ অনাসক্তি, নিরভিমানতা, অহংবুদ্ধিশূন্যতা। এই-সব লক্ষণ যার হয়, তার আর animal food (আমিষাহার)-এর ইচ্ছা হয় না। আর যেখানে দেখবি, মনে ঐ-সব গুণের স্ফূর্তি নেই; অথচ অহিংসার দলে নাম লিখিয়েছে -- সেখানে জানবি হয় ভন্ডামি, না হয় লোক-দেখানো ধর্ম। তোর যখন ঠিক ঠিক সত্ত্বগুণের অবস্থা হবে, তখন আমিষাহার ছেড়ে দিস।


শিষ্য -- কিন্তু মহাশয়, ছান্দোগ্য-শ্রুতিতে তো আছে, 'আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ -- শুদ্ধ বস্তু আহার করিলে সত্ত্বগুণের বৃদ্ধি হয়, ইত্যাদি। অতএব সত্ত্বগুণী হইবার জন্য রজঃ ও তমোগুণোদ্দীপক পদার্থসকলের ভোজন পূর্বেই ত্যাগ করা কি এখানে শ্রুতির অভিপ্রায় নহে?


স্বামীজী -- ঐ শ্রুতির অর্থ করতে গিয়ে শঙ্করাচার্য বলেছেন -আহার-অর্থে 'ইন্দ্রিয়-বিষয়', আর শ্রীরামানুজস্বামী আহার-অর্থে 'খাদ্য' ধরেছেন। আমার মত হচ্ছে -- তাঁদের ঐ উভয় মতের সামঞ্জস্য করে নিতে হবে। কেবল দিনরাত খাদ্যাখাদ্যের বাদবিচার করে জীবনটা কাটাতে হবে, না ইন্দ্রিয়সংযম করতে হবে? ইন্দ্রিয়সংযমের জন্যই ভাল-মন্দ খাদ্যাখাদ্যের অল্পবিস্তার করতে হবে। শাস্ত্র বলেন, খাদ্য ত্রিবিধ দোষে দুষ্ট ও পরিতাজ্য হয়: (১) জাতিদুষ্ট -- যেমন পেঁয়াজ, রশুন ইত্যাদি। (২) নিমিত্তদুষ্ট -- যেমন ময়রার দোকানের খাবার, দশগন্ডা মাছি মরে পড়ে রয়েছে, রাস্তার ধূলোই কত উড়ে পড়েছে! (৩) আশ্রয়দুষ্ট - যেমন অসৎ লোকের দ্বারা স্পৃষ্ট অন্নাদি। খাদ্য জাতিদুষ্ট ও নিমিত্তদুষ্ট হয়েছে কি না, তা সকল সময়েই খুব নজর রাখতে হয়। কিন্তু এদেশে ঐদিকে নজর একেবারেই উঠে গেছে। কেবল শেষোক্ত দোষটি - যা যোগী ভিন্ন অন্য কেউ প্রায় বুঝতেই পারে না, তা নিয়েই যত লাঠালাঠি চলছে, ছুঁয়োনা, ছুঁয়োনা' করে ছুঁৎমার্গীর দল দেশটাকে ঝালাপালা করছে। তাও ভালমন্দ লোকের বিচার নেই; গলায় একগাছা সুতো থাকলেই হল, তার হাতে অন্ন খেতে ছুঁৎমার্গীদের আর আপত্তি নেই। খাদ্যের আশ্রয়দোষ ধরতে পারা একমাত্র ঠাকুরকেই দেখেছি। এমন অনেক ঘটনা হয়েছে, যেখানে তিনি কোন কোন লোকের ছোঁয়া খেতে পারেননি। বিশেষ অনুসন্ধানের পর জানতে পেরেছি -- বাস্তবিকই সে সকল লোকের ভিতর কোন-না-কোন বিশেষ দোষ ছিল। তোদের যত কিছু ধর্ম এখন দাঁড়িয়েছে গিয়ে ভাতের হাঁড়ির মধ্যে! অপর জাতির ছোঁয়া ভাতটা না খেলেই যেন ভগবান-লাভ হয়ে গেল! শাস্ত্রের মহান সত্যসকল ছেড়ে কেবল খোসা নিয়েই মারামারি চলছে।


স্বামী শিষ্য সংবাদ ২৬

স্থান -- বেলুড় মঠ 

কাল -- (ঐ নির্মাণকালে) ১৮৯৮


(★এরকম পোস্ট নিয়মিত পেতে ফেসবুক পেজটি ফলো করে রাখুন ★)

দিব্যত্রয়ী - The Holy Trio



No comments:

Post a Comment

শ্রীরামকৃষ্ণ ও তোতাপুরী

  তো তাপুরী যখন দক্ষিণেশ্বরে এলেন তখন তিনি মধ্যবয়সী প্রৌঢ়, তিনি মন্দির চত্বরে পৌঁছেই প্রথমে গেলেন ঘাটের কাছে, সেখানে তখন অনেকেই বসে ছিলেন,...