Wednesday, 11 December 2024

Swami Premananda

 


🌼 *স্বামী প্রেমানন্দ*🌼


হুগলি জেলার অন্তঃপাতী আঁটপুর গ্রামে বহু ব্রাহ্মণ ও কায়স্থের বাস। তাঁহাদের মধ্যে ঘোষ ও মিত্র বংশের বিশেষ প্রতিপত্তি। স্বামী প্রেমানন্দের পিতা শ্রীযুক্ত তারাপদ ঘোষ এবং মাতা শ্রীমতী মাতঙ্গিনী যথাক্রমে ঘোষ ও মিত্র বংশে জন্মগ্রহণ করেন। বিবাহের পর ইহারা কৃষ্ণভাবিনী নাম্নী একটি কন্যার মুখদর্শন করেন এবং পরে তুলসীরাম, বাবুরাম ও শান্তিরাম নামক তিনটি পুত্র মাতঙ্গিনীর ক্রোড় অলঙ্কৃত করেন। মধ্যম পুত্র বাবুরামই আমাদের স্বামী প্রেমানন্দ। ইঁহার জন্মকাল ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৬ অগ্রহায়ণ (১০ ডিসেম্বর, ১৮৬১), মঙ্গলবার, রাত্রি ১১টা ৫৫ মিনিট, চান্দ্র অগ্রহায়ণ, শুক্লা নবমী তিথি। বাবুরামের জন্মগ্রহণের কিঞ্চিৎ পূর্বে কিংবা ঐ বৎসরই তারাপদ ঘোষ মহাশয় স্বীয় দুহিতা কৃষ্ণভাবিনীকে উড়িষ্যার কোঠারের জমিদার শ্রীযুক্ত বলরাম বসু মহাশয়ের হস্তে অর্পণ করেন এবং বাবুরামের জন্মের কয়েক বৎসর পরেই স্বর্গারোহণ করেন।


🌼বাবুরাম ছিলেন বড় বংশের বড় আদরের দুলাল। কিন্তু তিনি যে সাধারণ সংসারী জীব নহেন, ইহা অতি শৈশবকাল হইতেই তাঁহার জীবনে পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছিল। কেহ যদি তাঁহাকে বিবাহের কথা বলিয়া বিরক্ত করিত, তিনি অমনি অর্ধস্ফুট ভাষায় বলিয়া উঠিতেন, “না, বিয়ে দিও না; মরে যাব, মরে যাব।” কিশোর বয়সে নদীতীরে কোন সন্ন্যাসী দেখিলেই সময় ভুলিয়া তাঁহার সহিত আলাপে মগ্ন হইতেন। আর অষ্টম বর্ষ বয়সে তিনি কল্পনা করিতেন, কোন সন্ন্যাসীর সহিত লোকচক্ষুর অন্তরালে বৃক্ষলতাবৃত একটি ক্ষুদ্র আশ্রমে কালযাপন করিতেছেন।


আঁটপুরের ঘোষপরিবার স্বীয় কুলদেবতা লক্ষ্মীনারায়ণ জীউর সেবায় বিশেষ রত ছিলেন। দানধ্যানাদি সম্বন্ধেও তাঁহাদের যথেষ্ট সুযশ ছিল।


🌼মাস্টার একদা মাস্টার মহাশয় বেলুড় মঠে আসিলে বাবুরাম মহারাজ তাঁহার পার্শ্বে বসিয়া ঠাকুরের কথা বলিতে বলিতে অকস্মাৎ তাঁহার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া উপস্থিত সকলকে জানাইলেন, “এই তো এঁরই কৃপায় জীবন ধন্য হয়ে গেল। ইনি যদি ঠাকুরের কাছে না নিয়ে যেতেন, তা হলে কি ঠাকুরের কৃপা পেতুম?” মাস্টার মহাশয় কিন্তু ততোধিক বিনীতভাবে আপত্তি জানাইলেন, “ওসব কি বলা হচ্ছে? শুদ্ধসত্ত্ব ঠাকুরের অন্তরঙ্গ—তিনিই টেনে নিয়েছিলেন।”


অবশ্য জোড়াসাঁকোর এক হরিসভায় ইতঃপূর্বেই বাবুরাম একদিন দৈবক্রমে শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন পাইয়াছিলেন—ঠাকুর সেখানে শ্রীমদ্ভাগবত শুনিতে গিয়ে ছিলেন।


🌼দক্ষিণেশ্বরে প্রথম মিলনদিবসেই' ঠাকুর বাবুরামকে সন্নেহে আপন জনের ন্যায় গ্রহণ করিয়াছিলেন। বাবুরামের সুঠাম সুকোমল দেহ, উজ্জ্বল গৌরবর্ণ ও ভক্তোচিত সুবিনীত আচরণ প্রভৃতি সদ্‌গুণ-দর্শনে তাঁহার চিনিতে বাকি রহিল না যে, মা যাঁহাদিগকে ঈশ্বরকোটি বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন, ইনি তাঁহাদেরই অন্যতম। বাবুরামের অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদি-নিরীক্ষণের ফলেও তাঁহার এই ধারণাই বদ্ধমূল হইল; কারণ শ্রীমতী শ্রীরাধিকার অংশে যাঁহার জন্ম তিনি এইরূপ সর্বপ্রকার সুলক্ষণসম্পন্নই হইয়া থাকেন। সর্বশেষে যখন জানিলেন যে, তিনি ভক্তপ্রবর

 বলরামের নিকট আত্মীয় এবং শ্রীমতীরই অংশে জাত কৃষ্ণভাবিনী ঠাকুরানীর ভ্রাতা তখন আর তাঁহার আনন্দের অবধি রহিল না। বাবুরামও দক্ষিণেশ্বরে যেন স্বীয় শৈশবস্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত দেখিতে পাইলেন—এই তো শৈশবের স্বপ্নানুরূপ পূতসলিলা সাগরবাহিনী সুরধুনী, সেই নির্জন পঞ্চবটী এবং তৎসংলগ্ন বহুতপস্যাপৃত সাধনভূমি—কি মনোরম, কি নিস্তব্ধ! আর এই তো সেই পরব্রহ্মে লীন লোকাতীতচরিত্র পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণ।


🌼শ্রীযুক্ত বলরাম বসু আপন শ্বশ্রূমাতাকে ইহার পূর্বেই শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত পরিচয় করাইয়া দিয়াছিলেন। ভক্তিমতী মাতঙ্গিনী ঠাকুরানীর ঈশ্বরনির্ভরতার পরিচয় শ্রীরামকৃষ্ণ পূর্বেই পাইয়াছিলেন এবং ইষ্ট-লাভের জন্য তাঁহার অদেয় কিছুই নাই, ইহা বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তাই বাবুরামের আগমনের পরে একদিন মাতঙ্গিনী দেবীর নিকট প্রার্থনা করিলেন, “এই ছেলেটিকে তুমি আমায় দাও।” এই অদ্ভুত ও অপ্রত্যাশিত যাচ্ঞায় কিঞ্চিন্মাত্র বিচলিত না হইয়া মাতঙ্গিনী উত্তর দিলেন, “বাবা, আপনার নিকট বাবুরাম থাকবে, এ তো অতি সৌভাগ্যের কথা।” বাবুরামের মনও তখন পরমহংসদেবের আরও ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যের জন্য লালায়িত ছিল; অতএব ঠাকুরের আহ্বান ও গর্ভধারিণীর সম্মতি পাইয়া তিনি প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া বাস করিতে লাগিলেন। ঐ কালে পরম কারুণিক ঠাকুরের স্নেহ শতধা প্রকাশিত হইত। বাবুরাম সম্বন্ধে তিনি বলিতেন, “ও আমার দরদী।” আবার সুর করিয়া গাহিতেন,


“মনের কথা কইব কি সই?—কইতে মানা । 

দরদী নইলে প্রাণ বাঁচে না।”


🌼পরবর্তী জীবনে ঠাকুরের ভালবাসার উল্লেখ করিয়া বাবুরাম মহারাজ মঠের সাধু- ব্রহ্মচারীদিগকে বলিতেন, “আমি কি আর তোদের ভালবাসি? যদি ভালবাসতাম তা হলে তোরা আমার আজীবন গোলাম হয়ে থাকতিস। আহা, ঠাকুর আমাদের কত ভালবাসতেন! তার শতাংশের এক ভাগও আমরা তোদের ভালবাসি না। কোন কোন দিন রাত্রে তাঁকে হাওয়া করতে করতে আমি ঘুমিয়ে পড়তুম; তিনি আমাকে তাঁর মশারির ভেতর নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতেন। আমি আপত্তি করতুম, কারণ তাঁর বিছানা আমার ব্যবহার করা কি ঠিক? তাতে তিনি বলতেন, ‘বাইরে তোকে মশায় কামড়াবে; যখন দরকার হবে আমি জাগিয়ে দেব'।”


🌼বাবুরাম কলকাতা হইতে দীর্ঘকাল না ফিরিলে ঠাকুর অস্থির হইয়া পড়িতেন এবং তাঁহার জন্য ছুটিয়া দারুণ গ্রীষ্মকালেও কলকাতায় যাইতেন। এইরূপে ১৮৮৫

 খ্রিস্টাব্দের এক চৈত্রের দিনে বলরাম-মন্দিরে আসিয়া বলিয়াছিলেন, “বলে ফেলেছি—তিনটের সময় যাব, তাই আসছি, কিন্তু বড় ধুপ।... ছোট নরেনের জন্য বাবুরামের জন্য এলাম।” ('কথামৃত' ৩য় ভাগ, ১৪৩ পৃঃ; অখণ্ড সং, পৃঃ ৭৮৫)। বাবুরাম সম্বন্ধে ঠাকুর বলিতেন, “নৈকষ্য কুলীন, হাড় শুদ্ধ।” ভাবমুখে তিনি দেখিয়াছিলেন, বাবুরাম “দেবীমূর্তি, গলায় হার, সখী সঙ্গে”, আর বলিয়াছিলেন, "ও স্বপ্নে কি পেয়েছে, ওর দেহ শুদ্ধ। একটু কিছু করলেই ওর হয়ে যাবে। কি জানো, দেহরক্ষার অসুবিধা হচ্ছে। ও এসে থাকলে ভাল হয়।” (ঐ, ৪র্থ ভাগ, ১১২ পৃঃ, অখণ্ড সং, পৃঃ ৪৬০)। আর একদিন বলিয়াছিলেন, “কাল ভাবাবস্থায় একপাশে থেকে পায়ে ব্যথা হয়েছিল, তাই বাবুরামকে নিয়ে যাই—দরদী” (ঐ, ১৫২পৃঃ, অখণ্ড সং, পৃঃ ৫২১)। ভাবাবস্থায় ঠাকুর সকলের স্পর্শ সহ্য করিতে পারিতেন না। পড়িয়া যাইতেছেন দেখিয়া অকস্মাৎ কেহ ধরিতে গেলে তিনি কষ্ট অনুভব করিতেন; সুতরাং ঐ সময় ধরিয়া থাকিবার জন্য 'দরদী' ও নৈকষ্য কুলীন' বাবুরামকে সঙ্গে সঙ্গে ফিরিতে হইত। ঠাকুর যদ্যপি অব্রাহ্মণের হস্তে অন্নগ্রহণ করিতে পারিতেন না, তথাপি বাবুরামের পবিত্রতা-সম্বন্ধে সন্দেহমাত্র না থাকায় এক সময় তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, “তুই আমায় একদিন রেঁধে দিস, তোর হাতে খাব।” অবশ্য কার্যত উহা আর ঘটিয়া উঠে নাই।


🌼প্রেমানন্দের প্রেম ভক্তসেবায় কোন বাধা মানিত না। কেহ মঠে আসিলে প্রসাদ না পাইয়া ফিরিতে পারিত না। একদিন জনৈক ভক্ত প্রসাদ না লইয়া চলিয়া যাইতেছেন দেখিয়া তিনি ঠাকুর-ভাণ্ডারীকে কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। তিনি বলিলেন, “ইনি একটুও দাঁড়ালেন না—কি করে প্রসাদ দিই?” বিরক্ত হইয়া প্রেমানন্দ উত্তর দিলেন, “তবু ডেকে এনে দিতে হয়—যখন মঠের ভেতর এসে পড়েছে। সংসারে থাকলে না নিজে খেতে পেতিস, না বাছাদের মুখে দুটো দিতে পারতিস। এখানে ঠাকুরের এত আসছে—হাতে করে তুলে দিতে পারবি নি?”


🌼মঠের রাস্তায় বাবুরাম মহারাজকে স্বহস্তে চোরকাঁটা উঠাইতে দেখিয়া জনৈক ভক্ত সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ, আপনি কেন এ কাজ করছেন?” প্রেমানন্দ অমনি উত্তর দিলেন, “ভক্তেরা কষ্ট করে আসে—অসুবিধা হয়; তাই তাদের পথের কাঁটা সরিয়ে দিচ্ছি।” কে জানে এই সামান্য চোরকাঁটার সঙ্গে তিনি কোন অজানা জগতের পথের কাঁটা সরাইতেছিলেন।


🌼উৎসবের দিনে মঠ প্রাঙ্গণে ভদ্রলোক, মুচি, মেথর, ধনী, দরিদ্র-নব নারায়ণই পঙ্ক্তিভোজনে বসিয়াছেন। খিচুড়ি পরিবেশন হইতেছে। তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত স্বামী প্রেমানন্দ দেখিলেন, দূরে এক পক্তি হইতে বারংবার খিচুড়ি দাও, খিচুড়ি দাও' এই রব উঠিতেছে। তিনি অবিলম্বে সেখানে উপস্থিত হইয়া পরিবেশককে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কি আর কখনো পরিবেশন করনি?” উত্তর পাইলেন, “আমি বার বার দিচ্ছি, তবু কুলাচ্ছে না; এরা দাও দাও বলে শুধু গোল করছে।” প্রেমানন্দ দেখিলেন, পঙ্ক্তির প্রায় সবই গরিব—ইহাদের অধিক আহার করাই অভ্যাস। তাই সমবেদনায় ব্যথিত হইয়া আবেগভরে বলিলেন, “আমাদের পেটের ওজনে কি এদের পেটের ওজন করা যায়! জানি না জীবনে কদিন এরা পেটভরে খেতে পায়—এদের পেটে যে দিনরাত আগুন জ্বলছে। যাও যাও, বালতিটা এদের এক এক পাতে ঢেলে দাও। ঠাকুরের প্রসাদ পেট ভরে খেয়ে নিক।” বলিতে বলিতে স্বর শুষ্ক হইয়া আসিল, নয়নকোণে বারি ঝরিয়া পড়িল—প্রেমানন্দ আর সামলাইতে না পারিয়া অন্যত্র চলিয়া গেলেন ।


🌼মহাসমাধির পূর্বে একদিন তিনি স্বামী সারদানন্দকে অন্যমনস্কভাবে বলিয়াছিলেন, “চাঁপা ফুলের মতো রং কাপড় পড়তে ইচ্ছা করে, আর বেলফুলের মতো ধবধবে অন্ন খেতে ইচ্ছা করে।” শুনিয়া এক পরিপক্ববুদ্ধি ব্রাহ্মণ চিত্তা করিয়াছিলেন, “আমরা গৃহস্থ, অত সব জোগাড় কি করে করব?” তিনি কি করিয়া জানিবেন যে, হ্লাদিনী শক্তি হইতে বিচ্ছুরিত হইয়া যে মূর্তি মর্তধামে ভগবৎ কার্যসাধনের জন্য এতকাল নিয়োজিত ছিলেন, আজ তিনি স্বরূপে লীন হইতে চাহেন?—বাবুরাম মহারাজ এই দৈব ভাষায় তারই পূর্বাভাস দিলেন মাত্র।


প্রেমানন্দ স্বামী প্রেমের হাট ভাঙ্গিয়া চলিয়া গেলেন। নিদারুণ সংবাদ চারিদিকে বিস্তৃত হইয়া সকলের মনে মর্মান্তিক আঘাত প্রদান করিল। পূজনীয় মাস্টার মহাশয় শুনিয়া বলিলেন, “ঠাকুরের প্রেমের দিকটা চলে গেল।” শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানী অশ্রুবিসর্জন করিতে করিতে বলিলেন, “মঠের শক্তি, ভক্তি, যুক্তি—সব আমার বাবুরামের রূপ ধরে মঠের গঙ্গাতীর আলো করে বেড়াত। হায়, ঠাকুর তাকেও নিয়ে গেলেন!” 

     🌼 *শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্তমালিকা*🌼


(★এরকম পোস্ট নিয়মিত পেতে ফেসবুক পেজটি ফলো করে রাখুন★)

দিব্যত্রয়ী - The Holy Trio

No comments:

Post a Comment

শ্রীরামকৃষ্ণ ও তোতাপুরী

  তো তাপুরী যখন দক্ষিণেশ্বরে এলেন তখন তিনি মধ্যবয়সী প্রৌঢ়, তিনি মন্দির চত্বরে পৌঁছেই প্রথমে গেলেন ঘাটের কাছে, সেখানে তখন অনেকেই বসে ছিলেন,...