🍁*বেলুড় মঠে স্বামীজীর দুর্গা পুজোর ইতিহাস*🍁:-
স্বামী বিবেকানন্দ প্রবর্তিত বেলুড় মঠের দুর্গাপূজা (১৯০১) শতবর্ষ পার হয়ে গেলেও আজও তা মহা আড়ম্বরেই উদযাপিত হয়। যদিও সন্ন্যাসীরা বৈদিক পূজা বা ক্রিয়াকা- করার অধিকারী নন, তবুও তারা এ পুজো করেছিলেন কেন এ কৌতূহল সবার।১৮৯৩ সালে আমেরিকা থেকে স্বামীজী তাঁর প্রিয় গুরু ভাই স্বামী শিবানন্দজীকে একটি চিঠি লিখেন। বিশ্বধর্ম সভায় স্বামীজীর তখন জয়-জয়কার। এই সময়েই তিনি শ্রী রামকৃষ্ণ আন্দোলনকে বিশ্বব্যাপী বিস্তার করার মানসেই একটি স্থায়ী মঠ নির্মাণের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। শক্তিরূপিণী মা সারদামণি তাঁর এই প্রেরণার উৎস। তখনও বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শক্তিরূপিণী মা সারদা সম্বন্ধে স্বামী শিবানন্দজীকে লিখিত তাঁর একটি চিঠি থেকে যা জানা যায় তা হলো "...আমাদের দেশ সকলের অধম কেন, শক্তিহীন কেন? শক্তির অবমাননা সেখানে বলে। মা-ঠাকুরাণী ভারতে পুনরায় সেই মহাশক্তি জাগাতে এসেছেন, তাঁকে অবলম্বন করে আবার সব গার্গী, মৈত্রেয়ী জগতে জন্মাবে।...এই জন্য তাঁর মঠ প্রথমে চাই।" এ জন্যই মঠের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন স্বামীজী। মাতৃময়ী শক্তিরূপিণী মা সারদাকে স্বামীজী ভালভাবেই চিনেছিলেন। মা সারদা সবার প্রিয় মা। এক সময় (সম্ভবত ১৮৯১ সাল) গ্রামে একজন বৈরাগী হরিদাস এসে প্রায়ই একটি আগমনী গান গাইত। 'কি আনন্দের কথা উমে (গো মা)(ওমা) লোকমুখে শুনি সত্য বল শিবানি,অন্নপূর্ণা নাম তোর কি কাশীধামে?অপর্ণে তোমায় যখন অর্পণ করি। ভোলানাথ ছিলেন মুষ্টির ভিখারী।' এই গান শুনে চোখের কোণে জলে ভরে উঠত সারদার মা শ্যামা সুন্দরীর। এ গানের মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন মেয়ে সারদার জীবনের প্রতিচ্ছবি। কারণ পাড়াপ্রতিবেশী সবাই মেয়ে জামাতা গদাধরকে (রামকৃষ্ণ) সবাই পাগল, ক্ষ্যাপা বলত। কত কথা শুনতে হতো সারদার মাকে। রাত-দিন জামাই দক্ষিণেশ্বরে মা-মা করে কাঁদে পাগলের মতো। গাঁয়ের ছেলেবুড়ো সবাই কানাকানি করত সেসব। শুনে শ্যামাসুন্দরী কি যে দুঃখ পেতেন। তবু মনে ভরসা রাখতেন যে, সব মিথ্যে। জামাই আসলে সাক্ষাৎ শিব। সারদা স্বামীর কথা শুনে দক্ষিণেশ্বরে ছুটে গিয়েছিলেন। পরে দেখলেন মানুষের কথা সব মিথ্যে। ঈশ্বরে সমর্পিত চিত্ত ভাবে বিভোর স্বামীকে সকলে পাগল ভেবেছে।আর এই গদাধরের তথা শ্রীরামকৃষ্ণের যোগ্য সহধর্মিণী এই মা সারদা। স্বামীজী সে কথা বুঝেছিলেন বলেই মাকে শক্তিরূপে জেনেছিলেন। এমন কি এই শক্তিময়ী মাকে "জ্যান্ত দুর্গারূপে" পুজোও করেছিলেন। দুর্গা হলো মহাশক্তিরূপা। তাই দুর্গাপূজা হলো শক্তি দেবতারই আরাধনা। এই শক্তি মূলত মাতৃরূপে সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারকারী রূপে প্রকাশিতা।বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠিত হবার সময় গোড়া থেকে নিষ্ঠাবান হিন্দুদের মধ্যে স্বামীজী সম্পর্কে এক বিরূপ মনোভাব ছিল। কারণ তাদের মতে, স্বামীজী বিদেশ প্রত্যাগত, তাই সেই মঠে আচার নিষ্ঠা সম্বন্ধে অনেকেরই সন্দেহ ছিল। তারা সন্ন্যাসীদের নিয়ে নানা কাল্পনিক গল্প বানাত ও নিন্দাচর্চা করত। কিন্তু পরে স্বামীজীর ভক্তিভাবের পূজানুষ্ঠান তাদের সে ধারণাকে পাল্টে দেয়।আবার এও শোনা যায়, স্বামীজী যখন বেলুড় মঠে দুর্গাপূজা করার বিষয় চিন্তা করছিলেন, সে সময় তাঁর জনৈক সন্ন্যাসী ভ্রাতার একটি অলৌকিক স্বপ্ন দর্শনও হয়। তিনি দেখেন যে সাক্ষাৎ মা দশভুজা দক্ষিণেশ্বরের দিক থেকে গঙ্গার ওপর দিয়ে বেলুড় মঠের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। এ স্বপ্ন বৃত্তান্ত অবগত হবার পর স্বামীজী পুজোর আরেক উৎসাহী হয়ে ওঠেন। যথা সময়ে মায়ের অনুমতিও মিলল। আবার স্বামীজী খুশি মনে রঘুনন্দনের একখানা "অষ্টাবিংশতি-তত্ত্ব" ও সংগ্রহ করেন। স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর ওপর পুজোর উপকরণ সংগ্রহের ভার পড়েছিল। যথাসময়ে কুমোরটুলী থেকে প্রতিমা এসেছিল।পুজোর ক'দিন বেলুড় মঠে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। পুজোয় বোধনের আগের দিন থেকেই স্বামীজীর জ্যান্ত দুর্গা শ্রী মা বেলুড় মঠের পাশেই একটি ভাড়াটে বাড়িতে এসে ওঠেন। ষষ্ঠীর দিন থেকেই বেলুড় মঠে আনন্দ আর ধরে না। শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের শিষ্যরা তো নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। এছাড়া বেলুড়, বালি ও উত্তর পাড়ার নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণেরাও আমন্ত্রিত হয়েছিল। তবে শোনা যায়, এরপর থেকে গোঁড়া হিন্দুদের বেলুড় মঠ সম্বন্ধে বিদ্বেষ কমতে শুরু করে।১ কার্তিক (১৮ অক্টোবর) ষষ্ঠীতে বিশ্বতলায় দেবীর বোধন হয়। "গিরি গণেশ আমার শুভকারী,পূজে গণপতি পেলাম হৈমবতীচাঁদের মালা যেন চাঁদ সারি সারি ॥বিশ্ব বৃক্ষ মূলে পাতিয়া বোধন,গণেশের কল্যাণে গৌরীর আগমন,ঘরে আনব চণ্ডী, কর্ণে শুনব চণ্ডীআসবে কত দণ্ডী জটাজুটধারী।" স্বামীজীর সেই আগমনী গানই সবার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়। শ্রী মায়ের অনুমতি নিয়েই শ্রীদুর্গার বোধন, অধিবাস ও ষষ্ঠীপূজা এবং পূজায় অধিষ্ঠিত হন ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল এবং তন্ত্রধারক হলেন স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের (শশী মহারাজ) পূর্বাশ্রমের পিতা ঈশ্বর চন্দ্র চক্রবর্তী।পূজারীর দীর্ঘকেশ রুদ্রাক্ষমালা পরিশোভিত অবয়ব দাড়ি-গোঁফ সংবলিত তেজোদীপ্ত, মুখমণ্ডলকণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ সকলকে বিমুগ্ধ করে তোলে। পূর্ণসলিলা গঙ্গাবক্ষে ভোরে সানাইয়ের সুমধুর রাগ-রাগিণী আকাশে বাতাসে সুর ছড়ায়। আর ঢাকের আওয়াজে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে।সপ্তমীর দিন স্বামীজী সবার সঙ্গে হাসি, কৌতুক, এদিক-ওদিক পায়চারী করেছেন, কখনওবা ধ্যানমগ্ন, শান্ত সমাহিত চিত্তে বসে আছেন। কখনও বা গুনগুন করে গান গাইছেন -"সদানন্দময়ী কালী, মহাকালের মনোমোহিনী।তুমি আপনি নাচ, আপনি গাও,আপনি দাও মা করতালি"। রোববার মহাষ্টমী। মঠে অসংখ্য নর-নারী পুজোয় ভিড় করেছে। কেউ কেউ স্বামীজীকে দর্শন করতে এসেছেন। চারদিকে আনন্দ আর আনন্দ আনন্দ যেন আর ধরে না। হাজার হাজার লোক বসে প্রসাদ গ্রহণ করছে। বিশেষ করে দরিদ্র নারায়ণের বিশেষ যত্ন এই ছিল স্বামীজীর আদেশ। কিন্তু তিনি মহাষ্টমীর দিন জ্বরে শয্যাশায়ী হলেন। 'শ্রী শ্রী মায়ের কথায়' (প্রথমভাগ) -এ আছে শ্রী মা বলছেন, "পুজোর দিন লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। ছেলেরা সবাই খাটছে। নরেন এসে বলে কি, 'মা, আমার জ্বর করে দাও।' ওমা, বলতে না বলতে খানিকবাদে হাড় কেঁপে জ্বর এল। আমি বলি, 'ওমা একি হলো, এখন কি হবে?' নরেন বললে, 'কোন চিন্তা নাই মা। আমি সেধে জ্বর নিলুম এই জন্যে যে, ছেলেগুলো প্রাণপণ করে তো খাটছে, তবু কোথাও কি ত্রুটি হবে, আমি রেগে যাব বকব, চাই কি দুটো থাপ্পড়ই দিয়ে বসব। তখন ওদেরও কষ্ট হবে। আমারও কষ্ট হবে। তাই ভাবলুম কাজ কি, থাকি কিছুক্ষণ জ্বরে পড়ে।'" পরদিন সোমবার। প্রাতে সন্ধিপূজা ভোর সাড়ে ছয়টার কিছু পরে সন্ধিপূজা আরম্ভ স্বামীজী পূজামন্ডপে এসে বসলেন। শ্রীদুর্গা মায়ের রাঙ্গা চরণে পুষ্পাঞ্জলি দিলেন। উজ্জ্বল, জ্যোতির্ময় সহাস্য মুখমণ্ডল ভাবগম্ভীরভাবে বসে আছেন। যথাবিধি কুমারী পূজাও হলো। স্বামীজীও কুমারী পূজা করলেন। সে এক অপূর্ব দৃশ্য : শ্রী মা তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সাধারণত অষ্টমীতেই কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু স্বামীজী অসুস্থ ছিলেন বলে পরে পুজো করলেন।বেলুড় মঠের দুর্গাপূজার একটি বিশেষ অনুষঙ্গ হলো কুমারী পূজা। শ্রী রামকৃষ্ণ কুমারীকে ভগবতীর অংশ বলেছেন। শ্রী মা সারদা দেবীকে ষোড়শী রূপে পূজা করা আবার সাধনার শেষে শ্রী রামকৃষ্ণ ষোড়শী রূপিণী জগন্মাতার শ্রীচরণে তাঁর সব সাধনার ফল সমর্পণ করেন। শ্রী রামকৃষ্ণের মতে, মাতৃভাব বড় শুদ্ধভাব কুমারীকে দেবী দেখা তাকে জননীজ্ঞানে পূজা করা সেই শুদ্ধ সত্ত্বভাবেরই সার্থক প্রকাশ।বেলুড় মঠের দুর্গাপূজায় মায়ের নির্দেশে পশুবলি নিষিদ্ধ হয়। তবে নিয়ম রক্ষা কল্পে কিছু ফল বলি হিসেবে উৎসর্গ করা হয়। তাই নবমীতে পশুবলি হয় না।মহানবমীর সন্ধ্যা আরতির পর স্বামীজী স্বয়ং ভজন গান গাইলেন। ঠাকুর যেসব গান নবমীর রাতে গাইতেন সেসব গানেরই কয়েকটি গাওয়া হয়েছিল।নবমী নিশি পোহালেই বিজয়াদশমী। ৫ কার্তিক মঙ্গলবার বিজয়া দশমী। বেলুড় মঠের আনন্দ মুখরিত চারটি দিনের পরিসমাপ্তি এই বিজয়া দশমীর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। বেলাশেষে দলে দলে লোক মঠে বিসর্জন দেখতে ভিড় জমায়। গঙ্গতীরে মঠের ঘাটটি লোকে-লোকারণ্য হলো। ঢাকঢোল, সানাইর সঙ্গে ইংরেজী বাদ্য ব্যান্ড বেজে ওঠে। গঙ্গাবক্ষে যখন নৌকায় প্রতিমা তোলা হয় তখন চারদিকে "গঙ্গামায়ী কী জয় দুর্গামায়ী কী জয়" শত শত কণ্ঠে ধ্বনিত হয়। স্বামী ব্রহ্মানন্দ নৌকায় দেবী প্রতিমার সম্মুখে ভাবে বিভোর হয়ে নৃত্য করতে থাকেন। সবাই নৃত্য দেখতে থাকেন এমন কি স্বামীজী ভগ্ন স্বাস্থ্যে ভিড়ে নিচে নামেননি, কিন্তু মহারাজের নাচের কথা শুনে দোতলায় এসে নৃত্য উপভোগ করেন। আর গগনবিদারী "দুর্গা মায়ী কী জয় গঙ্গা মায়ী কী জয়" আওয়াজে এক সময় দেবীর বিসর্জন সম্পন্ন হয়।স্বামী বিবেকানন্দের প্রবর্তিত বেলুড় মঠের দুর্গাপূজা একশ আঠারোতম বছরের ঐতিহ্য বহন করে আজও মহা ধুমধামের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়।
তথ্যসূত্র : বেলুড় মঠে স্বামীজীর দুর্গা পূজা (স্বামী দেবেন্দ্রানন্দ)
জয় মা দুর্গা
জয় ঠাকুর মা স্বামীজী