Thursday, 19 December 2024

শ্রীরামকৃষ্ণ ও তোতাপুরী

 




তোতাপুরী যখন দক্ষিণেশ্বরে এলেন তখন তিনি মধ্যবয়সী প্রৌঢ়, তিনি মন্দির চত্বরে পৌঁছেই প্রথমে গেলেন ঘাটের কাছে, সেখানে তখন অনেকেই বসে ছিলেন, অনেকের সঙ্গে অবশ্য রামকৃষ্ণও ছিলেন। কিন্তু তাঁর সন্ধানী চোখ রামকৃষ্ণকে ঠিক খুঁজে নিল, তিনি বুঝতে পারলেন এই যুবক আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা।




তোতাপুরী সোজা রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কাছে এসে বললেন , “তোকে উত্তম অধিকারী মনে হচ্ছে। বেদান্ত সাধনা করবি?” শান্ত কন্ঠে রামকৃষ্ণ জবাব দিলেন,“ কী করব তার আমি কী জানি? সব জানেন মা। তিনি হ্যাঁ বললে , আমি করব” তোতাপুরী তখন বললেন,“ তবে যা, তোর মাকেই জিজ্ঞাসা করে আয়।” তোতাপুরী ভেবে ছিলেন, রামকৃষ্ণ তার মানবী মায়ের কথা বলছেন, কিন্তু তোতাপুরী অবাক হয়ে দেখলেন যে, রামকৃষ্ণ গিয়ে ঢুকলেন মা কালীর মন্দিরে আর কিছুক্ষণ পরে রামকৃষ্ণদেব বেরিয়ে এলেন ভাবে টলোমলো, বাহ্য চেতনশূন্য অবস্থায়। আনন্দে উৎপন্ন হয়ে তাকে বললেন,“ মাকে জিজ্ঞেস করলুম, মা বললেন, যা শেখ, তোকে শেখাবে বলেই তো অত দূর থেকে এসেছে।” রামকৃষ্ণের সরল নিষ্পাপ মুখ দেখে তোতাপুরী তখন মুগ্ধ‌।




পঞ্চবটির পূর্ব দিকের একটি চালা ঘরে রামকৃষ্ণকে দীক্ষা দিলেন তোতাপুরী, এই চালা ঘরের বর্তমান নাম ধ্যান ঘর। তিন দিন, তিন রাত বাহ্য জ্ঞান বিলুপ্ত হয়ে রামকৃষ্ণ ধ্যান করে চলেছেন, দেহে সাড়া নেই, মুখে শব্দ নেই, মুখমন্ডল দিব্যজ্যোতিতে উদ্ভাসিত, তালা খুলে ঘরে ঢুকে তোতা রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কে এই রূপে , এইভাবে দেখে স্তম্ভিত। অবাক হওয়ারই কথা! এত তাড়াতাড়ি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব যে এই কঠিন বিদ্যা আয়ত্ত্ব করে ফেলবেন তা বুঝতে পারেননি তিনি!




রামকৃষ্ণের উপরে দেবীর এই মায়া দেখে তোতাপুরী বলে উঠলেন, যেটি লাভ করতে আমায় কয়েক বছর কঠোর সাধনা করতে হয়েছে যুবক রামকৃষ্ণ সেটি একদিনে পেয়ে গেলেন! তবু তোতাপুরী পরীক্ষা করে দেখলেন, হ্যাঁ,হয়েছে, হৃদস্পন্দন হচ্ছে না, সত্যিকারের নির্বিকল্প। তোতাপুরী বার বার ‘হরি ওম’ মন্ত্র আবৃত্তি করতে লাগলেন, অবশেষে সমাধি থেকে রামকৃষ্ণ জেগে উঠলেন ও লুটিয়ে পড়লেন তোতাপুরীর সামনে। তোতাও শিষ্যকে দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে আপ্লুত হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। ইনিই সেই তোতাপুরী যিনি শ্রীরামকৃষ্ণ কে বলেছিলেন গীতার সার,‘ গীতা ১০ বার বললে যা হয় তাই গীতার সার অর্থাৎ ত্যাগী ত্যাগী’ , রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে তিনি বলেছিলেন, “ঘটি একদিন মাজলে কী হবে- ফেলে রাখলে আবার কলঙ্ক পড়বে।”-অর্থাৎ সাধনা ভজনার মধ্যে সব সময় থাকতে হয়, দীর্ঘ সময় সাধনা করবার পর কোন এক মুহূর্ত ফাঁকি দিয়ে যদি সংসারে মন দেওয়া হয়, তাহলে সেই এক‌ই অবস্থা হয়!




তোতাপুরী ভাবতেন মূর্তি পুজো বা উপাসনা একমাত্র কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভ্রান্ত পথিকেরাই করে থাকে, বেদান্তজ্ঞান হলে প্রকৃত জ্ঞানের আলোয় অজ্ঞানের সকল অন্ধকার কুসংস্কার আপনা থেকে চলে যায়। তোতাপুরী তাই ঠাকুরকে জ্ঞানমার্গের উপদেশ দিতে সন্মত হয়েছিলেন।




মূর্তির মধ্যে কখনও ভগবৎশক্তির বিকাশ হতে পারে না বলেই বেদান্তী তোতাপুরীর দৃঢ় ধারণা ছিল। নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসক তিনি। একমাত্র বেদান্ত বিজ্ঞানের অনুধ্যানেই সেই সত্য অনুভূত হয়‌। সেখানে মূর্তি পুজোর কোন প্রয়োজন থাকতে পারে না।




মন্দিরের দেবী মূর্তিকে ঠাকুর মা রূপে সম্বোধন করে অনুমতি নিয়েছেন শুনে তোতাপুরীর মনে সংশয় দেখা দেয়। তিনি ভাবতে থাকেন ঠাকুর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। পাষান মূর্তি পুজোয় বিশ্বাসী।




নিরাকার ব্রহ্মে বিশ্বাসী ছিলেন তোতাপুরী। তত্ত্বজ্ঞান লাভ করে নির্গুণ পরমাত্মার দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। অন্য কোনো দেবীর অনুগ্রহ প্রার্থনা করা তাঁর কল্পনায় আসেতে পারেনি। তাঁর ধারণা ছিল মানুষ পুরুষাকার অবলম্বন করে পরমজ্ঞান যা সত্যস্বরূপ জ্ঞানস্বরূপ সেই পরমেশ্বরকে জানতে পারে। 




বেদান্তী গুরুর দীক্ষা নিতে হলে আগে ঠাকুরকে শিখাসূত্র ত্যাগ করতে হবে এবং শাস্ত্রবিধানানুযায়ী সন্ন্যাস গ্রহণ করতে হবে। সন্মত হয়ে ঠাকুর বললেন― 'সন্ন্যাস তিনি গোপনে নেবেন, যাতে তাঁর বৃদ্ধা মা কোনোক্রমে ব্যথা না পান'। ঠাকুরের কথায় সন্মতি জানিয়ে তোতাপুরী বললেন― 'বেশ তাই হবে'। 




পঞ্চবটীতে সাধনের আসন পাতলেন তোতাপুরী। নির্দিষ্ট দিনে ঠাকু্রকে দিয়ে পিতৃপুরুষদের শান্তির জন্য শ্রাদ্ধাদি কর্ম করালেন এবং শিষ্যের নিজ আত্মার তৃপ্তির জন্য পিণ্ডদান করালেন। ঠাকুর তোতাপুরীকে বেদান্ত গুরু বলে গ্রহণ করে তাঁর সকল আদেশ পালন করে পঞ্চবটীতে আসন পেতে দীক্ষালাভের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।




পুরী তীর্থ বাসের গোড়ার দিকে নাঙ্গা বাবা থাকতেন সাগর তীরে। এক শ্মশানে সারাদিন ধ্যানস্থ থাকার পর সন্ধ্যায় একটু আগে বাবা একসের দুধ আর দুটি ডাব আহার হিসেবে গ্রহণ করতেন, মধু গোয়ালা রোজ ভক্তি ভরে বাবার পান করার জন্য এই দুধ যোগাত। গোয়ালার সঙ্গে থাকতো তার বালক পুত্র বংশীধর, রোজ একজোড়া ফুলের মালা নাঙ্গা বাবার গলায় পরিয়ে দিয়ে এসে ভক্তি ভরে প্রণাম করত বংশীধর।




মধু গোয়ালার ছেলে বংশীধর ছিল জন্ম থেকেই অন্ধ। তবে মধু গোয়ালা গরীব হলেও একমাত্র ছেলের চোখের চিকিৎসার কোনো কিছু ত্রুটি করেনি, সমস্ত জায়গায় সে চেষ্টা করেছে, কিন্তু সব চেষ্টাই তার ব্যর্থ হয়েছে। এই মধু গোয়ালা বুঝেছিল চিকিৎসক যখন হাত তুলে নেয় তখন অবতার পুরুষ এবং ঐশ্বরিক কৃপায় অলৌকিক সাধন হয়। একদিন মধু গোয়ালা তাই ছেলেকে বলে দিলো, আজ মালা দেওয়ার পর বাবাকে প্রণাম করে চোখের দৃষ্টি প্রার্থনা করবি। বংশীধর কেঁদে কেঁদে বাবার কাছে মিনতি জানালো, বাবা আমি জন্মান্ধ আপনি আমার উপর কৃপা করুন। নাঙ্গা বাবা চোখ মেলে তাকালেন, তার মনে দয়া হল, বললেন, “বাচ্চো, দেখো অভি সে তুম আন্ধা নেহি, পুরা দৃষ্টি তোমার আঁখ মে আ গিয়া” বংশীধরের দৃষ্টিও তখন খুলে গেলো, চোখের সামনে সব কিছু দেখতে পেয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো সে।




এরপর নাঙ্গা বাবা গির্ণারীর বন্তায় তাঁর আশ্রম স্থাপন করেন কিন্তু আসন বিছিয়ে কিছুদিন কোথাও অবস্থান করার পরই হঠাৎ একদিন মহাপুরুষ কোথায় অন্তর্ধান করতেন, কিছুদিন পর দেখা যেতো, কোনো বনে শ্মশানে বা সাগরতটে, যেখানে যেতেন সেখানেই আশ্চর্য ভাবে তার সঙ্গী জুটে যেতো, কিন্তু কোন সঙ্গীকে তিনি সঙ্গে রাখতে চাইতেন না, বলতেন, আমি ন্যাংটা মানুষ, কোন রকম কৃচ্ছসাধনাতেই আমার কষ্ট হয় না, তোমরা কেন আমার সঙ্গে থেকে কষ্ট করবে?




১৯২১ সালের মাঝামাঝি নাঙ্গা বাবা আবার পুরীতে ফিরে আসেন। অন্তরঙ্গ ভক্তরা খুশি হয় বাবার ফিরে আসায়। পুরীর অন্যতম জমিদার কৃষ্ণ বাবুর স্ত্রী তুলসী দেবী ছিলেন নাঙ্গা বাবার অন্যতম ভক্ত, তিনি অক্লান্তভাবে বাবার সেবা করতেন, একবার নাঙ্গা বাবা কাউকে কিছু না বলে পুরীধাম থেকে অন্তর্হিত হলেন। বাবার হঠাৎ এই অন্তর্ধানে অত্যন্ত কষ্ট পেয়ে তুলসী দেবী প্রতিজ্ঞা করলেন, যতদিন না বাবা পুরীধামে ফিরবেন, ততদিন তিনি থাকবেন উপবাসী, খুবই আশ্চর্যের কথা এই মহিলা ভক্তের অনশনব্রত চলে প্রায় দু বছর ধরে। নাঙ্গা বাবার অলৌকিক কৃপার ফলেই তা সম্ভব হয়েছিল, দুইবছর পর ভক্তরা খবর পেলেন নাঙ্গা বাবা ভাগলপুরের কাছে এক গভীর অরণ্যে তপস্যা রত অবস্থায় আছেন-তখন কৃষ্ণ বাবু ছুটে সেখানে গেলেন ও নাঙ্গা বাবাকে সব ঘটনা খুলে বললেন, সব শুনে বাবা আর একমুহুর্ত দেরী না করে ফিরে এলেন পুরী ধামের আশ্রমে। বাবা ছিলেন কৃপার সাগর, প্রচুর মানুষের কল্যাণ করেছেন তিনি, অসংখ্য মানুষকে রক্ষা করেছেন ব্যাধির থেকে, অসংখ্য ভক্তের রোগ তিনি স্বেচ্ছায় নিয়েছেন নিজের দেহে।




একবার একজন দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্থকে রক্ষা করার পর বাবা বললেন, এই আমার তুণে রাখা শেষ বাণ। এরপরই নাঙ্গা বাবা কাল রোগে আক্রান্ত হলেন ও প্রায় একশো ষাট বছর জীবন যাপনের পর ১৯৬১ সালের ২৮ শে আগস্ট ইহজাগতিক লীলার অবসান ঘটিয়ে পাড়ি দিলেন অনন্ত লোকে।



#সংগৃহীত 


(★এরকম পোস্ট নিয়মিত পেতে ফেসবুক পেজটি ফলো করে রাখুন ★)

দিব্যত্রয়ী - The Holy Trio

Wednesday, 18 December 2024

শ্রীরামকৃষ্ণ ও যুগধর্ম



 -::"ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও যুগধর্ম"::-


একদিন জনৈক নবাগত ব্যক্তি উদ্বোধনে স্বামী সারদানন্দ মহারাজকে কথাপ্রসঙ্গে বলছেন, আমি সাধুসঙ্গ করতে এসেছি । স্বামী সারদানন্দ মহারাজ বললেন, তা তো করতে এসেছ, কিন্তু ঠাকুর যখন দক্ষিণেশ্বরে ছিলেন, দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির ঠাকুর চাকর বামুন চব্বিশ ঘণ্টা তাঁর সঙ্গে থাকত এবং  দক্ষিণেশ্বরবাসী পাড়াপ্রতিবেশী যারা সর্বদা সেখানে আসত, ঠাকুরকে দেখত, তাদের কারো জীবনে যে বিশেষ কিছু পরিবর্তন হয়েছে এমন দেখা যায়নি । সুতরাং ঠাকুরের প্রদীপ্ত সান্নিধ্যে থেকেও তাঁকে জানতে পারা যায়নি । সেক্ষেত্রে আমরা তাঁকে বুঝে ফেলব এ কল্পনা একেবারে অলীক, আকাশকুসুমের মতো । অবতারকে কেউ বুঝতে পারে না । অবতার সম্বন্ধে ঠাকুর বলছেন, একরকম গাছ আছে জান ? ঠিক দেখতে গাছের মতো, ডালপালা ফলফুল সব হয়, কিন্তু সেটি কি গাছ তা কেউ জানে না । তাই লোকে তাকে বলে অচিন গাছ । কেউ চেনে না এই জন্য তার নাম অচিন । অবতার যখন আসেন তিনি ঐরকম অচিন গাছ হয়েই আসেন । আমাদের সঙ্গে মানুষের মতো ব্যবহার করেন, কিন্তু তিনি মানুষ হয়েও যে মানুষ নন একথা বুঝতে পারে কে ? তাঁর কৃপায় যে তাঁর স্বরূপ ধারণা করবার চেষ্টা করে একটু সার্থকতা লাভ করেছে সে পারে । তার মাপকাঠি দিয়ে সে যখন বুঝতে যায়, সেই সীমিত মাপকাঠি দিয়ে যতটুকু বোঝা সম্ভব ততটুকুই বুঝতে পারে ।

একটি উপদেশে ঠাকুর বলছেন যে, একজন জহুরি তার ভৃত্যকে একটি বহুমূল্য রত্ন দিয়ে তার বাজারদর যাচাই করে আসতে বললে । সে বাজারে যেখানে তরিতরকারি বিক্রি হয় সেখানে গিয়ে বেগুনওয়ালাকে বললে, এটার কি দাম দেবে বল তো ? বেগুনওয়ালা বললে, বেশ চক্‌চক্‌ করছে, মন্দ না তো । তা আমি ওর জন্য এক সের বেগুন দিতে পারি । যে বিক্রি করতে এসেছে সে বললে, আর একটু বাড়াও না । ‘না বাপু, আর একটাও নয় ।’ সে ফিরে এসে মণিবকে বললে, এক সের বেগুন দেবে বললে । তারপর তিনি আর একটু বড়দরের ব্যাপারির কাছে পাঠালেন— সে কি বলে । সে আর একটু মাত্রা বাড়িয়ে বললে । তারপরে বললেন, এইবার একজন ভাল জহুরির কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর । জহুরির কাছে যেতে সে দেখেই বললে, এ তো অমূল্য জিনিস, এ তুমি কোথায় পেলে ? আমার যত সম্পত্তি আছে সব বিক্রি করেও এর দাম আমি দিতে পারব না । যে জহুরি জহর চেনে সে এই কথাটি বুঝতে পারে, কিন্তু সেরকম জহুরি কজন আছে ? আমরা সাধারণ মানুষ অবতার সম্বন্ধে কতটুকু বুঝতে পারি ? কিন্তু অবতারকে জানবার সামর্থ্য যদি আমাদের না-ই থাকে তাহলে অবতারের আমাদের কাছে আসার সার্থকতা কি ? তাঁর আসা না আসা তো সমান হয়ে যাচ্ছে । তা নয় । ভগবান মানুষের মধ্যে মানুষের বেশে আসেন, আর তাঁর এই আসার ফলে মানুষের একটা নতুন দৃষ্টি উন্মোচিত হয় । সে তার মনুষ্যত্বের চরম আদর্শ দেখতে পায় । সেই আদর্শ সম্বন্ধে তার ধারণা যতটুকু ততটুকুর ভিতর দিয়ে সে দেখে । ক্রমশঃ এই ধারণার বিস্তার হতে থাকে । যে বেগুন বিক্রি করছে তার চেয়ে যে কাপড় বিক্রি করছে তার ধারণা একটু বেশি । আর জহুরি যে, তার ধারণা আরও বেশি । এই রকম শ্রীরামকৃষ্ণকে বুঝবার জন্য আমরা নিজের নিজের ছোট্ট মাপকাঠি দিয়ে বিচার করে দেখতে গিয়ে দেখি মাপে কুলোয় না ।


    "স্বামী ভূতেশানন্দ।"


(★এরকম পোস্ট নিয়মিত পেতে ফেসবুক পেজটি ফলো করে রাখুন ★)

দিব্যত্রয়ী - The Holy Trio 



Tuesday, 17 December 2024

শ্রীমা সরদার অলৌকিক ঘটনা

 


-::শ্রীশ্রী   মায়ের   কথা::-

 *===========🪷============*   

      _প্রথম প্রথম বুঝতে পারিনি যে, আমাদের পিসিমা সাক্ষাৎ দেবী । একদিনের একটি ঘটনা জীবনে ভুলতে পারব না । পিসিমার বাড়ির সামনের পুণ্যিপুকুরে মাছ ধরার খবর দিলেন মহারাজরা । আমি দলবল নিয়ে সকাল করেই হাজির হলাম । সম্ভবতঃ রাসপূর্ণিমার দিন ছিল ।_


_পাড়াগাঁয়ে পুকুরে জাল নামালে প্রতিবেশীরা পুকুরপাড়ে এসে দেখে । সেদিন দেখি, পিসিমাও তাঁর দুই ভাইঝিকে নিয়ে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়েছেন । হয়তো ভাইঝিরা মাছধরা দেখার বায়না ধরেছিল, তাই বাধ্য হয়ে তাঁকে পুকুরপাড়ে আসতে হয়েছিল ।_ 


_পিসিমাকে পুকুরপাড়ে দেখে খুব আনন্দ হয়েছিল । মনে হয়েছিল, আজ যখন পিসিমা স্বয়ং পুকুরপাড়ে এসেছেন, তখন তাঁর হাতে একটা বড় মাছ দেব ঠাকুরের ভোগের জন্য । ঐ পুকুরে দু-একটা বড় মাছ থাকতই । সেগুলো পুরোনো মাছ - খুব বড় । তারা সহজে জালে পড়ত না । জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে যেত । ঐ সমস্ত মাছ আটকাতে খুব পরিশ্রম হতো; মাঝে মাঝেই জলে ডুব দিয়ে জালের তলা ঠিক করে দিতে হতো । ঐ সমস্ত মাছ জাল উল্টে বেরিয়ে যায় । সেদিনও মাঝে মাঝে জলে ডুব দিয়ে জাল ঠিক করতে ব্যস্ত আছি, কিন্তু মন পড়ে আছে পিসিমার কাছে । সবসময় তাঁকে লক্ষ্য করছি । ভাবছি, হয়তো এক্ষুণি তিনি ঘরে চলে যাবেন ।_ 


_এইরকম ভাবতে ভাবতে পিসিমার দিকে চোখ রাখতেই দেখি এক আশ্চর্য্য দৃশ্য । দেখি, পিসিমা তাঁর ভাইঝিদের এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রেখে পুকুরপাড় ধরে পূবদিকে কোথায় যেন যাচ্ছেন । কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি তাঁর সঙ্গে আরও দুজন মহিলা - একই কাপড়, একই পাড়, একই রকম মাথায় ঘোমটা । যদিও তাঁদের সামনাসামনি দেখতে পাচ্ছিলাম না, তবু দেখে মনে হল বাকি দুজনের মুখের আদলও যেন পিসিমার মতো ।_ 


_এই দৃশ্য দেখে আমিতো চমকে উঠলাম । তাড়াতাড়ি জল থেকে ডাঙায় উঠে দেখতে ইচ্ছা হলো । হলে কি হবে, সবই বিধাতার ইচ্ছা ! যেই না আমি পুকুরপাড়ের কাছাকাছি এসেছি, একটা বড় মাছ গায়ে লেজের ঝাপটা দিয়ে চলে গেল । আমিও তখন পাড়ে ওঠার কথা ভুলে গিয়ে জাল ঠিক করতে লেগে গেলাম ।_ 


_...সেদিন পুকুরপাড়ে যা দেখেছিলাম সেকথা তাঁকে কিছু বলিনি । পরে পিসিমাকে একদিন ফাঁকা পেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "আচ্ছা পিসিমা, ঐ মাছ ধরার দিনে আপনি যখন ভাইঝিদের নিয়ে পুকুরপাড়ে গিয়েছিলেন, তখন আপনার সঙ্গে আর দুজন বউ কে ছিল - ঠিক আপনার বয়সী, আপনার মতো দেখতে, আপনার মতো কাপড় পরে ছিল তারা ?"_


_পিসিমা আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে বললেন, "কে আবার থাকবে ? আমি ওদের দাঁড় করিয়ে রেখে বেলতলায় গিয়েছিলাম - গিমেশাক হয়েছে কিনা দেখতে । রাধু-মাকুতো এধারে দাঁড়িয়েই ছিল ।"_


_আমি আবার বললাম, " না গো পিসিমা, আপনি যখন বেলতলা যাচ্ছিলেন, তখনি আপনার আগে-পিছে দুজন মেয়েলোককে আমি দেখেছি । আপনি যে মাঝে রয়েছেন তাও বুঝতে পেরেছি ।"_


_পিসিমা হেসে বললেন, "তোর পেট গরম হয়েছে - মিছরি ভিজিয়ে খা ।" এই বলেই পিসিমা ঘরে ঢুকে গেলেন । তখনো চমকে উঠলাম -- দেখি, আবার সেই দৃশ্য -- পিসিমা মাঝে, তাঁর আগে ও পিছে দুজন মেয়ে । আমি আবার চিৎকার করে বললাম, "পিসিমা !"_ 


_তখন পিসিমা ঘরের ভিতর থেকে সাড়া দিয়ে বললেন, "লালু, একটু বোস । প্রসাদ নিয়ে যাবি ।" পরে তিনি এসে মুড়কি ও ফলপ্রসাদ দিলেন । পিসিমা সেদিন কিছুতেই স্বীকার করেননি, কিন্তু আমি কিছুতেই ভুলতে পারিনি সে-দৃশ্য । দু-দুবার দেখেছি -- একই রকম চেহারা নিয়ে দুজন মেয়েলোক পিসিমার আগে ও পিছনে ।_


_*লালমোহনে দাস*_

*_________________________*

*তথ্যসূত্রঃ* শ্রীশ্রীমায়ের পদপ্রান্তে।

🌾🍁🌾🍁🌾🍁🌾🍁🌾🍁🌾


(★এরকম পোস্ট নিয়মিত পেতে ফেসবুক পেজটি ফলো করে আমাদের পাশে থাকুন ★)

দিব্যত্রয়ী - the holy trio


আমিষ নিরামিষ বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দ


 

⚜️আমিষ-নিরামিষ আহার বিষয়ে স্বামীজীর একটি সুন্দর আলোচনা:- ⚜️


শিষ্য -- স্বামীজী, খাদ্যাখাদ্যের সহিত ধর্মাচরণের কিছু সম্বন্ধ আছে কি?


স্বামীজী -- অল্পবিস্তর আছে বইকি।


শিষ্য -- মাছ-মাংস খাওয়া উচিত এবং আবশ্যক কি?


স্বামীজী -- খুব খাবি বাবা! তাতে যা পাপ হবে, তা আমার। তোদের দেশের লোকগুলোর দিকে একবার চেয়ে দেখ দেখি -- মুখে মলিনতার ছায়া, বুকে সাহস ও উদ্যম শূন্যতা, পেটটি বড়, হাতে পায়ে বল নেই, ভীরু ও কাপুরুষ!


শিষ্য -- মাছ-মাংস খাইলে যদি উপকারই হইবে, তবে বৌদ্ধ ও বৈষ্ণবধর্মে অহিংসাকে ‘পরমো ধর্মঃ” বলিয়াছে কেন?


স্বামীজী -- বৌদ্ধ ও বৈষ্ণবধর্ম আলাদা নয়। বৌদ্ধধর্ম মরে যাবার সময় হিন্দুধর্ম তার কতকগুলি নিয়ম নিজেদের ভেতরে ঢুকিয়ে আপনার করে নিয়েছিল। ঐ ধর্মই এখন ভারতবর্ষে বৈষ্ণবধর্ম বলে বিখ্যাত। 'অহিংসা পরমো ধর্মঃ' -- বৌদ্ধধর্মের এই মত খুব ভাল, তবে অধিকারী বিচার না করে বলপূর্বক রাজশাসনের দ্বারা ঐ মত জনসাধারণ সকলের উপর চালাতে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম দেশের মাথাটি একেবারে খেয়ে দিয়ে গেছে। ফলে হয়েছে এই যে, লোকে পিঁপড়েকে চিনি দিচ্ছে, আর টাকার জন্য ভায়ের সর্বনাশ করছে! অমন ‘বক-ধার্মিক' এ জীবনে অনেক দেখেছি। অন্যপক্ষে দেখ - বৈদিক ও মনুক্ত ধর্মে মৎস্য-মাংস খাবার বিধান রয়েছে, আবার অহিংসার কথাও আছে। অধিকারি-বিশেষে হিংসা ও অধিকারিবিশেষে অহিংসা-ধর্মপালনের ব্যবস্থা আছে। শ্রুতি বলছেন -- 'মা হিংস্যাৎ সর্বভূতানি'; মনুও বলেছেন -- 'নিবৃত্তিস্তু মহাফলা'।


শিষ্য -- কিন্তু এমন দেখিয়াছি মহাশয়, ধর্মের দিকে একটু ঝোঁক হইলেই লোক আগে মাছ-মাংস ছাড়িয়া দেয়। অনেকের চক্ষে ব্যভিচারাদি গুরুতর পাপ অপেক্ষাও যেন মাছ-মাংস খাওয়াটা বেশি পাপ! -- এ ভাবটা কোথা হইতে আসিল?


স্বামীজী -- কোত্থেকে এলো, তা জেনে তোর দরকার কি? তবে ঐ মত ঢুকে যে তোদের সমাজের ও দেশের সর্বনাশ সাধন করেছে, তা তো দেখতে পাচ্ছিস? দেখ না -- তোদের পূর্ববঙ্গের লোক খুব মাছ-মাংস খায়, কচ্ছপ খায়, তাই তারা পশ্চিম-বাঙলার লোকের চেয়ে সুস্থশরির। তোদের পূর্ববাক্ষলার বড় মানুষেরাও এখনো রাত্রে লুচি বা রুটি খেতে শেখেনি। তাই আমাদের দেশের লোকগুলোর মতো অম্বলের ব্যারামে ভোগে না। শুনেছি, পূর্ব- বাঙলার পাড়া গাঁয়ে লোকে অম্বলের ব্যারাম কাকে বলে, তা বুঝতেই পারে না।


শিষ্য -- আজ্ঞা হাঁ। আমাদের দেশে অম্বলের ব্যারাম বলিয়া কোন ব্যারাম নাই। এদেশে আসিয়া ঐ ব্যারামের নাম শুনিয়াছি। দেশে আমরা দুবেলাই মাছ-ভাত খাইয়া থাকি।


স্বামীজী -- তা খুব খাবি। ঘাসপাতা খেয়ে যত পেটরোগা বাবাজীর দলে দেশ ছেয়ে ফেলেছে। ও-সব সত্ত্বগুণের চিহ্ন নয়, মহা তমোগুণের ছায়া -- মৃত্যুর ছায়া। সত্ত্বগুণের চিহ্ন হচ্ছে -- মুখে উজ্জ্বলতা, হৃদয়ে অদম্য উৎসাহ, tremendous activity (প্রচন্ড কর্মতৎপরতা); আর তমোগুণের লক্ষণ হচ্ছে আলস্য, জড়তা, মোহ নিদ্রা -- এই সব।


শিষ্য -- কিন্তু মহাশয়, মাছ-মাংসে তো রজোগুণ বাড়ায়।


স্বামীজী -- আমি তো তাই চাই। একন রজোগুণেরই দরকার। দেশের যে-সব লোককে এখন সত্ত্বগুণী বলে মনে করছিস, চাদের ভেতর পনের আনা লোকই ঘোএ তমোভাবাপন্ন। এক আনা লোক সত্ত্বগুণী মেলে তো ঢের! এখন চাই প্রবল রজোগুণের তান্ডব উদ্দীপনা। দেশ যে ঘোর তমসাচ্ছন্ন, দেখতে পাচ্ছিস না? এখন দেশের লোককে মাছ-মাংস খাইয়ে উদ্যমী করে তুলতে হবে, জাগাতে হবে, কার্যতৎপর করতে হবে। নতুবা ক্রমে দেশসুদ্ধ লোক জড় হয়ে যাবে, গাছ-পাথরের মতো জড় হয়ে যাবে। তাই বলছিলুম, মাছ-মাংস খুব খাবি।


শিষ্য -- কিন্তু মহাশয়, মনে যখন সত্ত্বগুণের অত্যন্ত স্ফূর্তি হয়, তখন মাছ-মাংসে স্পৃহা থাকে কি?


স্বামীজী -- না, থাকে না। সত্ত্বগুণের যখন খুব বিকাশ হয়, তখন মাছ-মাংসে রুচি থাকে না। কিন্তু সত্ত্বগুণ- প্রকাশের এইসব লক্ষণ জানবি - পরের জন্য সর্বস্ব-পণ, কামিনী-কাঞ্চনে সম্পূর্ণ অনাসক্তি, নিরভিমানতা, অহংবুদ্ধিশূন্যতা। এই-সব লক্ষণ যার হয়, তার আর animal food (আমিষাহার)-এর ইচ্ছা হয় না। আর যেখানে দেখবি, মনে ঐ-সব গুণের স্ফূর্তি নেই; অথচ অহিংসার দলে নাম লিখিয়েছে -- সেখানে জানবি হয় ভন্ডামি, না হয় লোক-দেখানো ধর্ম। তোর যখন ঠিক ঠিক সত্ত্বগুণের অবস্থা হবে, তখন আমিষাহার ছেড়ে দিস।


শিষ্য -- কিন্তু মহাশয়, ছান্দোগ্য-শ্রুতিতে তো আছে, 'আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ -- শুদ্ধ বস্তু আহার করিলে সত্ত্বগুণের বৃদ্ধি হয়, ইত্যাদি। অতএব সত্ত্বগুণী হইবার জন্য রজঃ ও তমোগুণোদ্দীপক পদার্থসকলের ভোজন পূর্বেই ত্যাগ করা কি এখানে শ্রুতির অভিপ্রায় নহে?


স্বামীজী -- ঐ শ্রুতির অর্থ করতে গিয়ে শঙ্করাচার্য বলেছেন -আহার-অর্থে 'ইন্দ্রিয়-বিষয়', আর শ্রীরামানুজস্বামী আহার-অর্থে 'খাদ্য' ধরেছেন। আমার মত হচ্ছে -- তাঁদের ঐ উভয় মতের সামঞ্জস্য করে নিতে হবে। কেবল দিনরাত খাদ্যাখাদ্যের বাদবিচার করে জীবনটা কাটাতে হবে, না ইন্দ্রিয়সংযম করতে হবে? ইন্দ্রিয়সংযমের জন্যই ভাল-মন্দ খাদ্যাখাদ্যের অল্পবিস্তার করতে হবে। শাস্ত্র বলেন, খাদ্য ত্রিবিধ দোষে দুষ্ট ও পরিতাজ্য হয়: (১) জাতিদুষ্ট -- যেমন পেঁয়াজ, রশুন ইত্যাদি। (২) নিমিত্তদুষ্ট -- যেমন ময়রার দোকানের খাবার, দশগন্ডা মাছি মরে পড়ে রয়েছে, রাস্তার ধূলোই কত উড়ে পড়েছে! (৩) আশ্রয়দুষ্ট - যেমন অসৎ লোকের দ্বারা স্পৃষ্ট অন্নাদি। খাদ্য জাতিদুষ্ট ও নিমিত্তদুষ্ট হয়েছে কি না, তা সকল সময়েই খুব নজর রাখতে হয়। কিন্তু এদেশে ঐদিকে নজর একেবারেই উঠে গেছে। কেবল শেষোক্ত দোষটি - যা যোগী ভিন্ন অন্য কেউ প্রায় বুঝতেই পারে না, তা নিয়েই যত লাঠালাঠি চলছে, ছুঁয়োনা, ছুঁয়োনা' করে ছুঁৎমার্গীর দল দেশটাকে ঝালাপালা করছে। তাও ভালমন্দ লোকের বিচার নেই; গলায় একগাছা সুতো থাকলেই হল, তার হাতে অন্ন খেতে ছুঁৎমার্গীদের আর আপত্তি নেই। খাদ্যের আশ্রয়দোষ ধরতে পারা একমাত্র ঠাকুরকেই দেখেছি। এমন অনেক ঘটনা হয়েছে, যেখানে তিনি কোন কোন লোকের ছোঁয়া খেতে পারেননি। বিশেষ অনুসন্ধানের পর জানতে পেরেছি -- বাস্তবিকই সে সকল লোকের ভিতর কোন-না-কোন বিশেষ দোষ ছিল। তোদের যত কিছু ধর্ম এখন দাঁড়িয়েছে গিয়ে ভাতের হাঁড়ির মধ্যে! অপর জাতির ছোঁয়া ভাতটা না খেলেই যেন ভগবান-লাভ হয়ে গেল! শাস্ত্রের মহান সত্যসকল ছেড়ে কেবল খোসা নিয়েই মারামারি চলছে।


স্বামী শিষ্য সংবাদ ২৬

স্থান -- বেলুড় মঠ 

কাল -- (ঐ নির্মাণকালে) ১৮৯৮


(★এরকম পোস্ট নিয়মিত পেতে ফেসবুক পেজটি ফলো করে রাখুন ★)

দিব্যত্রয়ী - The Holy Trio



Sunday, 15 December 2024

শ্রীরামকৃষ্ণ ও ত্রৈলঙ্গ স্বামী


    (শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব)     (বাবা ত্রৈলঙ্গস্বামী)


🍁সালটা ১৮৬৮:-

শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর ভাগ্নে হৃদয়কে নিয়ে মথুরবাবুর সঙ্গে কাশীতে তীর্থ করতে এসেছেন। বিশ্বনাথ দর্শনের পর তিনি বললেন, ‘হৃদে চল, এ বার জীবন্ত বিশ্বনাথ দর্শন করে আসি’। হৃদে বলল, ‘জীবন্ত বিশ্বনাথ! তোমার মাথাটা এ বার সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে মামা’। শ্রীরামকৃষ্ণ একগাল হেসে বললেন, ‘আয় না রে পাগল... হাঁটা চলা করা, কথা বলা বিশ্বনাথ দেখবি চল’।


কাশীর মনিকর্ণিকা ঘাটে গিয়ে রামকৃষ্ণ দেখলেন, তাঁর জীবন্ত বিশ্বনাথ চোখ বুজে শুয়ে আছেন। রামকৃষ্ণ তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ধীরে ধীরে চোখ খুললেন মহাযোগী ত্রৈলঙ্গ স্বামী। সাগরের পথে চলতে চলতে দু’টি নদী যেন মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। অপলক দৃষ্টিতে দু’জন দু’জনকে দেখতে লাগলেন, অন্তরের গোপন ভাষায় তাঁরা কথা বললেন... এক মহাপুরুষ আর এক মহাপুরুষকে অনুভব করলেন চেতনার অনুভবে।


পরে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘ত্রৈলঙ্গ স্বামীই হলেন মানুষরূপী বিশ্বেশ্বর। আমি ইশারায় তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ঈশ্বর এক না অনেক? উনি ইশারায় আমাকে বলেছিলেন, সমাধিস্থ হয়ে দেখলে এক, না হলে যতক্ষণ আমি, তুমি, জীব, জগৎ ইত্যাদি নানা জ্ঞান রয়েছে, ততক্ষণ অনেক’।


কোনও শব্দ ব্যয় না করেই এই যে পারস্পরিক বোঝাপড়া, কোনও এক অন্তরের গোপন ভাষায়, তা তো সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়! তাই এই যোগাযোগ যেন অপার্থিব বলে মনে হয়।


শুধু শ্রীরামকৃষ্ণই নন, গৃহী-সন্ন্যাসী শ্যামাচরণ লাহিড়ী এবং প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সঙ্গে ত্রৈলঙ্গ স্বামীর সাক্ষাৎ-কাহিনিও একই রকম বিস্মিত করে আমাদের।


কী হয়েছিল?


এক দিন ত্রৈলঙ্গস্বামীর সঙ্গে দেখা করার জন্য কাশীর গঙ্গার তীরে তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শ্যামাচরণ লাহিড়ী। চোখ খুললেন বিশালবপু মহাযোগী। আর সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন শ্যামাচরণ। স্বামীর চোখ দুটোর ভিতর দিয়ে তিনি যেন সাক্ষী হয়ে রইলেন সমগ্র জগৎ সংসারের। ত্রৈলঙ্গ স্বামীও দু’চোখ ভরে দেখলেন তাঁকে। আবার চোখ বন্ধ করলেন। একটিও কথা বলেননি শ্যামাচরণ। শুধু মৃদু হেসে চলে গিয়েছিলেন সেখান থেকে।


পরে ত্রৈলঙ্গ স্বামী তাঁর ঘনিষ্ঠদের বলেছিলেন, ‘ওকে আর কী বলব? যোগমার্গের যে অবস্থায় পৌঁছে সাধক নির্দ্বিধায় তার লেংটিটাও ছুড়ে ফেলে দিতে পারে, বেটা ধুতি-পাঞ্জাবি পরেই সেই অবস্থায় অনেক দিন আগেই পৌঁছে গিয়েছে, ওকে আমার আর কিছু বলার নেই’।


শ্যামাচরণ লাহিড়ীর মতো এক দিন চমকে উঠেছিলেন প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীও। ত্রৈলঙ্গ স্বামীর সঙ্গে দেখা করবেন বলে অনেকদিন ধরেই তাঁকে অনুসরণ করছিলেন তিনি। সেই সময় স্বামী দিন-রাত গঙ্গার জলেই থাকতেন। সেখানেই তাঁর খাওয়া, শোয়া, বসা, ঘুমানো। জলস্রোতের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘুরে বেড়াতেন একঘাট থেকে অন্যঘাটে। আর বিজয়কৃষ্ণও তাঁকে অনুসরণ করে ছুটে বেড়াতেন গঙ্গার তীর ধরে। এ ভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন গঙ্গার ধারে এক কালীমন্দিরে বিজয়কৃষ্ণ দেখতে পেলেন ত্রৈলঙ্গ স্বামীকে। মন্দিরে ঢুকলেন। কিন্তু যে দৃশ্য দেখলেন তাতে স্তম্ভিত, রুদ্ধবাক হয়ে গেলেন তিনি। দেখলেন, কালীমূর্তির গায়ে নিজের প্রস্রাব ছিটিয়ে দিচ্ছেন ত্রৈলঙ্গস্বামী, নিজেও মাখছেন!


ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত বলে বিজয়কৃষ্ণ মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করতেন না ঠিকই, কিন্তু ত্রৈলঙ্গস্বামীর এই আচরণও মানতে পারলেন না। বিতৃষ্ণা গ্রাস করল তাঁকে। তিনি সেখান থেকে ফিরে গেলেন।


এর পর একদিন বিজয়কৃষ্ণের কাছে খবর এল, ত্রৈলঙ্গ স্বামী তাঁকে দীক্ষা দিতে চান। বিজয়কৃষ্ণ তাঁর কাছে গেলেন। স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট বললেন, ‘আমি আপনার কাছে দীক্ষা নেব না, আপনি কালী-মূর্তির গায়ে প্রস্রাব ছিটিয়ে দেন কেন? এমন অনাচারী মানুষের কাছে আমি দীক্ষা নেব না। তা ছাড়া আমি তো ব্রাহ্ম, আপনি আমাকে দীক্ষা দেবেন কী করে?’ এ কথা শুনে ছোট্ট বালকের মতো খিলখিল করে হেসে উঠলেন স্বামী। বললেন, ‘প্রস্রাব কোথায়! আমি তো গঙ্গাজল দিয়ে মায়ের পুজো করছিলাম। এই পৃথিবীর সব কিছুতেই ঈশ্বর আছেন, তাই এই পৃথিবীর সব কিছুই তাঁর পূজা-উপাচার। মনের চোখটাকে খুলে দিতে পারলেই সব কিছু একাকার হয়ে যায় রে... সব কিছু একাকার হয়ে যায়... যোগসাধনা দিয়েই সব একাকার করে নিতে হয় রে বেটা। শোন, আমি কারও গুরু নই, গুরু হতেও চাই না, তোর দেহ শুদ্ধিকরণের জন্য ঈশ্বরের আদেশে আমি তোকে দীক্ষা দিচ্ছি... তোর আসল গুরু তিনিই’। প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ বুঝতে পারলেন মহাযোগীর কথা। ভক্তিভরে দীক্ষা নিলেন তাঁর কাছ থেকে।


এর বেশ কিছুকাল পর, মহাযোগী হঠাৎ একদিন সবাইকে ডেকে বললেন, ‘আমার যাওয়ার সময় হয়েছে। এ বার আমি এই জীর্ণ শরীর ত্যাগ করব, তোরা আমাকে বিদায় দে...’। স্বামীজির এই অপ্রত্যাশিত, মর্মান্তিক সিদ্ধান্তে সবাই হতবাক হয়ে গেলেন। তাঁরা স্বামীকে অনেক অনুরোধ করলেন, চার দিকে কান্নার রোল উঠল, কিন্তু ত্রৈলঙ্গ স্বামীকে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে নড়ানো গেল না। শেষে সকলের অনুরোধে তিনি তাঁর দেহত্যাগের দিন একমাস পিছিয়ে দিলেন। এই একমাস ধরে গঙ্গার তীরে তাঁর একটি পাথরের মূর্তি তৈরি করা হল। নির্দিষ্ট দিনে সেই মূর্তির সামনেই মহাযোগী ত্রৈলঙ্গ স্বামী তাঁর জীর্ণ দেহ ছেড়ে চলে গেলেন অনন্তলোকে। আজও অগণিত ভক্ত বারাণসীর গঙ্গার ঘাটে ওই মূর্তিটিকেই মহাযোগী ত্রৈলঙ্গস্বামীর জীবন্ত সত্তা হিসেবে পুজো করেন, গঙ্গার জলে অঞ্জলি দেন তাঁর উদ্দেশে।


 🙏🏻।।জয় গুরু।।🙏🏻

🌷।।হরি ওঁ শ্রীরামকৃষ্ণ।।🌷


(★এরকম পোষ্ট নিয়মিত পেতে ফেসবুক পেজটি ফলো করে রাখুন★)

দিব্যত্রয়ী - The Holy Trio

Wednesday, 11 December 2024

Maa Sarada



🍁🍂🍁-:পশু পাখিরও মা:-🍁🍂🍁

🌿"মায়ের বাটীতে একটি চন্দনা পাখী বহু দিন যাবৎ আছে, পুরাতন বাড়িতেও ছিল। মা তাহাকে 'গঙ্গারাম' বলিয়া ডাকিতেন। গঙ্গারামকে সকালে ও সন্ধ্যায় মা বলিতেন, 'বাবা গঙ্গারাম। পড় তো, গঙ্গারাম পড়, বাবা, পড়।' গঙ্গারাম অমনি 'হরে কৃষ্ণ হরে রাম, কৃষ্ণ কৃষ্ণ রাম রাম' বলিয়া পড়িত।... মাঝে মাঝে গঙ্গারাম 'মা, মা, ওমা' বলিয়া ডাকিয়া উঠিলে শ্রীশ্রীমা তখনই বলিতেন, 'যাই বাবা, যাই।' এই বলিয়া শ্রীশ্রীমা তখনই গঙ্গারামকে ছোলা, জল, ফল ইত্যাদি খাইতে দিতেন।.. গঙ্গারামের 'মা,মা, ওমা' বলিয়া চীৎকার করার অর্থ--- তখন তাহার ক্ষুধা পাইয়াছে এবং তাহার বাটিতে হয়তো খাবার ছোলা-জল ফুরাইয়া গিয়াছে। যখনই ঐরূপ হইয়াছে, তখনই গঙ্গারাম ওইভাবে 'মা, মা, ওমা' বলিয়া ডাকিত। শ্রীশ্রীমা উহা বুঝিতে পারিয়াই বলিতেন, 'যাই, বাবা, যাই।' এই বলিয়া কিছু না কিছু খাবার গঙ্গারামকে দিতেন।"🌿

🖋️ মাতৃসান্নিধ্যে।
স্বামী ঈশানানন্দ,
উদ্বোধন কার্যালয়, পৃষ্ঠা সংখ্যা ২০০-২০১।

                    🔶️🔷️🔶️🔷️🔶️🔷️🔶️

🌱"একবার মঠ থেকে একটি গোরু এনে উদ্বোধন-এ রাখার কথা হয়েছিল। মা ঐকথা শুনেই বললেন : "না না, ওরা ওখানে গঙ্গাদর্শন করছে, স্বাধীনভাবে বিচরণ করছে। আর সাধুসঙ্গ হচ্ছে। এখানে এনে কিনা একটা ঘরে পুরে গলায় দড়ি দিয়ে রাখবে ! তা হবে না। অমন দুধ খেতে পারব না।" আনতে আর দিলেন না।
এতেই বোঝা যাচ্ছে, মা পিঁপড়েরও মা।"🌱

🖊️ শ্রীশ্রীমায়ের পদপ্রান্তে। 
সঙ্কলক ও সম্পাদক: স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ,
চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮৯৪।

🙏🏻🕉️জয়তু দিব্যত্রয়ী🕉️🙏🏻

(★এরকম পোস্ট নিয়মিত পেতে ফেসবুক পেজটি ফলো করে রাখুন ★)

🌿🏵️🌱🏵️🌿🏵️🌿🏵️🌱🏵️🌿

Shri Ramkrishna anudhyan

 



🌼-:*শ্রী রা ম কৃ ষ্ণ   অ নু ধ্যা ন*:-🌼 

*===========🪷===========*

-::*_ঠাকুরই পূর্ণব্রহ্ম ঈশ্বর_*::-


_*শিষ্য।*- মহাশয়, ঠাকুর যে পূর্ণব্রহ্ম ভগবান, এ কথা তিনি আপনাকে নিজ মুখে কখনও বলিয়াছিলেন কি?_


_*স্বামীজী।*- কতবার বলেছেন। আমাদের সবাইকে বলেছেন। তিনি যখন কাশীপুরের বাগানে --- যখন তাঁর শরীর যায় যায়, তখন আমি তাঁর বিছানার পাশে একদিন মনে মনে ভাবছি এই সময় যদি বলতে পারো 'আমি ভগবান', তবে বিশ্বাস করব --- তুমি সত্যসত্যই ভগবান। তখন শরীর যাবার দু-দিন মাত্র বাকি। ঠাকুর তখন হঠাৎ আমার দিকে চেয়ে *বললেন, 'যে রাম, যে কৃষ্ণ --- সে-ই ইদানিং এ শরীরে রামকৃষ্ণ, তোর বেদান্তের দিক দিয়ে নয়।'* আমি শুনে অবাক হয়ে রইলুম। প্রভুর শ্রীমুখে বার বার শুনেও আমাদেরই এখনও পূর্ণ বিশ্বাস হল না --- সন্দেহ, নিরাশায় মন মধ্যে মধ্যে আন্দোলিত হয় --- তা অপরের কথা আর কি বলব? আমাদেরই মতো দেহবান এক ব্যক্তিকে ঈশ্বর বলে নির্দেশ করা ও বিশ্বাস করা বড়ই কঠিন ব্যাপার। সিদ্ধ, ব্রহ্মজ্ঞ --- এ-সব বলে ভাবা চলে। তা যাই কেন তাঁকে বল না, ভাব না --- মহাপুরুষ বল, ব্রহ্মজ্ঞ বল, তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু ঠাকুরের মতো এমন পুরুষোত্তম জগতে এর আগে আর কখনও আসেননি। সংসারে ঘোর অন্ধকারে এখন এই মহাপুরুষই জ্যোতিঃস্তম্ভস্বরূপ।এঁর আলোতেই মানুষ এখন সংসার-সমুদ্রের পারে চলে যাবে।_


_*শিষ্য।*- মহাশয়, আমার মনে হয়, কিছু না দেখিলে শুনিলে যথার্থ বিশ্বাস হয় না। শুনিয়াছি, মথুরবাবু ঠাকুরের সম্বন্ধে কত কি দেখিয়াছিলেন! তাই ঠাকুরে তাঁর এত বিশ্বাস হইয়াছিল।_


_*স্বামীজী।*- যার বিশ্বাস হয় না, তার দেখলেও বিশ্বাস হয় না ; মনে করে মাথার ভুল, স্বপ্ন ইত্যাদি। দুর্যোধনও বিশ্বরূপ দেখেছিল, অর্জুনও দেখেছিল। অর্জুনের বিশ্বাস হল, দুর্যোধন ভেল্কিবাজি ভাবলে। তিনি না বুঝালে কিছু বলবার বা বুঝবার জো নেই। না দেখে না শুনে কারও ষোল-আনা বিশ্বাস হয় ; কেউ বার বৎসর সামনে থেকে নানা বিভূতি দেখেও সন্দেহে ডুবে থাকে। সার কথা হচ্ছে --- তাঁর কৃপা ; তবে লেগে থাকতে হবে, তবে তাঁর কৃপা হবে।_


*তথ্যসূত্রঃ*- স্বামীজীর বাণী ও রচনা, ৯ম খণ্ড ,পৃঃ - ৩৭

🌾🪻🌾🪻🌾🪻🌾🪻🌾🪻🌾


(★এরকম পোস্ট নিয়মিত পেতে ফেসবুক পেজটি ফলো করে রাখুন★)

দিব্যত্রয়ী - The Holy Trio

Swami Premananda

 


🌼 *স্বামী প্রেমানন্দ*🌼


হুগলি জেলার অন্তঃপাতী আঁটপুর গ্রামে বহু ব্রাহ্মণ ও কায়স্থের বাস। তাঁহাদের মধ্যে ঘোষ ও মিত্র বংশের বিশেষ প্রতিপত্তি। স্বামী প্রেমানন্দের পিতা শ্রীযুক্ত তারাপদ ঘোষ এবং মাতা শ্রীমতী মাতঙ্গিনী যথাক্রমে ঘোষ ও মিত্র বংশে জন্মগ্রহণ করেন। বিবাহের পর ইহারা কৃষ্ণভাবিনী নাম্নী একটি কন্যার মুখদর্শন করেন এবং পরে তুলসীরাম, বাবুরাম ও শান্তিরাম নামক তিনটি পুত্র মাতঙ্গিনীর ক্রোড় অলঙ্কৃত করেন। মধ্যম পুত্র বাবুরামই আমাদের স্বামী প্রেমানন্দ। ইঁহার জন্মকাল ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৬ অগ্রহায়ণ (১০ ডিসেম্বর, ১৮৬১), মঙ্গলবার, রাত্রি ১১টা ৫৫ মিনিট, চান্দ্র অগ্রহায়ণ, শুক্লা নবমী তিথি। বাবুরামের জন্মগ্রহণের কিঞ্চিৎ পূর্বে কিংবা ঐ বৎসরই তারাপদ ঘোষ মহাশয় স্বীয় দুহিতা কৃষ্ণভাবিনীকে উড়িষ্যার কোঠারের জমিদার শ্রীযুক্ত বলরাম বসু মহাশয়ের হস্তে অর্পণ করেন এবং বাবুরামের জন্মের কয়েক বৎসর পরেই স্বর্গারোহণ করেন।


🌼বাবুরাম ছিলেন বড় বংশের বড় আদরের দুলাল। কিন্তু তিনি যে সাধারণ সংসারী জীব নহেন, ইহা অতি শৈশবকাল হইতেই তাঁহার জীবনে পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছিল। কেহ যদি তাঁহাকে বিবাহের কথা বলিয়া বিরক্ত করিত, তিনি অমনি অর্ধস্ফুট ভাষায় বলিয়া উঠিতেন, “না, বিয়ে দিও না; মরে যাব, মরে যাব।” কিশোর বয়সে নদীতীরে কোন সন্ন্যাসী দেখিলেই সময় ভুলিয়া তাঁহার সহিত আলাপে মগ্ন হইতেন। আর অষ্টম বর্ষ বয়সে তিনি কল্পনা করিতেন, কোন সন্ন্যাসীর সহিত লোকচক্ষুর অন্তরালে বৃক্ষলতাবৃত একটি ক্ষুদ্র আশ্রমে কালযাপন করিতেছেন।


আঁটপুরের ঘোষপরিবার স্বীয় কুলদেবতা লক্ষ্মীনারায়ণ জীউর সেবায় বিশেষ রত ছিলেন। দানধ্যানাদি সম্বন্ধেও তাঁহাদের যথেষ্ট সুযশ ছিল।


🌼মাস্টার একদা মাস্টার মহাশয় বেলুড় মঠে আসিলে বাবুরাম মহারাজ তাঁহার পার্শ্বে বসিয়া ঠাকুরের কথা বলিতে বলিতে অকস্মাৎ তাঁহার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া উপস্থিত সকলকে জানাইলেন, “এই তো এঁরই কৃপায় জীবন ধন্য হয়ে গেল। ইনি যদি ঠাকুরের কাছে না নিয়ে যেতেন, তা হলে কি ঠাকুরের কৃপা পেতুম?” মাস্টার মহাশয় কিন্তু ততোধিক বিনীতভাবে আপত্তি জানাইলেন, “ওসব কি বলা হচ্ছে? শুদ্ধসত্ত্ব ঠাকুরের অন্তরঙ্গ—তিনিই টেনে নিয়েছিলেন।”


অবশ্য জোড়াসাঁকোর এক হরিসভায় ইতঃপূর্বেই বাবুরাম একদিন দৈবক্রমে শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন পাইয়াছিলেন—ঠাকুর সেখানে শ্রীমদ্ভাগবত শুনিতে গিয়ে ছিলেন।


🌼দক্ষিণেশ্বরে প্রথম মিলনদিবসেই' ঠাকুর বাবুরামকে সন্নেহে আপন জনের ন্যায় গ্রহণ করিয়াছিলেন। বাবুরামের সুঠাম সুকোমল দেহ, উজ্জ্বল গৌরবর্ণ ও ভক্তোচিত সুবিনীত আচরণ প্রভৃতি সদ্‌গুণ-দর্শনে তাঁহার চিনিতে বাকি রহিল না যে, মা যাঁহাদিগকে ঈশ্বরকোটি বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন, ইনি তাঁহাদেরই অন্যতম। বাবুরামের অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদি-নিরীক্ষণের ফলেও তাঁহার এই ধারণাই বদ্ধমূল হইল; কারণ শ্রীমতী শ্রীরাধিকার অংশে যাঁহার জন্ম তিনি এইরূপ সর্বপ্রকার সুলক্ষণসম্পন্নই হইয়া থাকেন। সর্বশেষে যখন জানিলেন যে, তিনি ভক্তপ্রবর

 বলরামের নিকট আত্মীয় এবং শ্রীমতীরই অংশে জাত কৃষ্ণভাবিনী ঠাকুরানীর ভ্রাতা তখন আর তাঁহার আনন্দের অবধি রহিল না। বাবুরামও দক্ষিণেশ্বরে যেন স্বীয় শৈশবস্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত দেখিতে পাইলেন—এই তো শৈশবের স্বপ্নানুরূপ পূতসলিলা সাগরবাহিনী সুরধুনী, সেই নির্জন পঞ্চবটী এবং তৎসংলগ্ন বহুতপস্যাপৃত সাধনভূমি—কি মনোরম, কি নিস্তব্ধ! আর এই তো সেই পরব্রহ্মে লীন লোকাতীতচরিত্র পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণ।


🌼শ্রীযুক্ত বলরাম বসু আপন শ্বশ্রূমাতাকে ইহার পূর্বেই শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত পরিচয় করাইয়া দিয়াছিলেন। ভক্তিমতী মাতঙ্গিনী ঠাকুরানীর ঈশ্বরনির্ভরতার পরিচয় শ্রীরামকৃষ্ণ পূর্বেই পাইয়াছিলেন এবং ইষ্ট-লাভের জন্য তাঁহার অদেয় কিছুই নাই, ইহা বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তাই বাবুরামের আগমনের পরে একদিন মাতঙ্গিনী দেবীর নিকট প্রার্থনা করিলেন, “এই ছেলেটিকে তুমি আমায় দাও।” এই অদ্ভুত ও অপ্রত্যাশিত যাচ্ঞায় কিঞ্চিন্মাত্র বিচলিত না হইয়া মাতঙ্গিনী উত্তর দিলেন, “বাবা, আপনার নিকট বাবুরাম থাকবে, এ তো অতি সৌভাগ্যের কথা।” বাবুরামের মনও তখন পরমহংসদেবের আরও ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যের জন্য লালায়িত ছিল; অতএব ঠাকুরের আহ্বান ও গর্ভধারিণীর সম্মতি পাইয়া তিনি প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া বাস করিতে লাগিলেন। ঐ কালে পরম কারুণিক ঠাকুরের স্নেহ শতধা প্রকাশিত হইত। বাবুরাম সম্বন্ধে তিনি বলিতেন, “ও আমার দরদী।” আবার সুর করিয়া গাহিতেন,


“মনের কথা কইব কি সই?—কইতে মানা । 

দরদী নইলে প্রাণ বাঁচে না।”


🌼পরবর্তী জীবনে ঠাকুরের ভালবাসার উল্লেখ করিয়া বাবুরাম মহারাজ মঠের সাধু- ব্রহ্মচারীদিগকে বলিতেন, “আমি কি আর তোদের ভালবাসি? যদি ভালবাসতাম তা হলে তোরা আমার আজীবন গোলাম হয়ে থাকতিস। আহা, ঠাকুর আমাদের কত ভালবাসতেন! তার শতাংশের এক ভাগও আমরা তোদের ভালবাসি না। কোন কোন দিন রাত্রে তাঁকে হাওয়া করতে করতে আমি ঘুমিয়ে পড়তুম; তিনি আমাকে তাঁর মশারির ভেতর নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতেন। আমি আপত্তি করতুম, কারণ তাঁর বিছানা আমার ব্যবহার করা কি ঠিক? তাতে তিনি বলতেন, ‘বাইরে তোকে মশায় কামড়াবে; যখন দরকার হবে আমি জাগিয়ে দেব'।”


🌼বাবুরাম কলকাতা হইতে দীর্ঘকাল না ফিরিলে ঠাকুর অস্থির হইয়া পড়িতেন এবং তাঁহার জন্য ছুটিয়া দারুণ গ্রীষ্মকালেও কলকাতায় যাইতেন। এইরূপে ১৮৮৫

 খ্রিস্টাব্দের এক চৈত্রের দিনে বলরাম-মন্দিরে আসিয়া বলিয়াছিলেন, “বলে ফেলেছি—তিনটের সময় যাব, তাই আসছি, কিন্তু বড় ধুপ।... ছোট নরেনের জন্য বাবুরামের জন্য এলাম।” ('কথামৃত' ৩য় ভাগ, ১৪৩ পৃঃ; অখণ্ড সং, পৃঃ ৭৮৫)। বাবুরাম সম্বন্ধে ঠাকুর বলিতেন, “নৈকষ্য কুলীন, হাড় শুদ্ধ।” ভাবমুখে তিনি দেখিয়াছিলেন, বাবুরাম “দেবীমূর্তি, গলায় হার, সখী সঙ্গে”, আর বলিয়াছিলেন, "ও স্বপ্নে কি পেয়েছে, ওর দেহ শুদ্ধ। একটু কিছু করলেই ওর হয়ে যাবে। কি জানো, দেহরক্ষার অসুবিধা হচ্ছে। ও এসে থাকলে ভাল হয়।” (ঐ, ৪র্থ ভাগ, ১১২ পৃঃ, অখণ্ড সং, পৃঃ ৪৬০)। আর একদিন বলিয়াছিলেন, “কাল ভাবাবস্থায় একপাশে থেকে পায়ে ব্যথা হয়েছিল, তাই বাবুরামকে নিয়ে যাই—দরদী” (ঐ, ১৫২পৃঃ, অখণ্ড সং, পৃঃ ৫২১)। ভাবাবস্থায় ঠাকুর সকলের স্পর্শ সহ্য করিতে পারিতেন না। পড়িয়া যাইতেছেন দেখিয়া অকস্মাৎ কেহ ধরিতে গেলে তিনি কষ্ট অনুভব করিতেন; সুতরাং ঐ সময় ধরিয়া থাকিবার জন্য 'দরদী' ও নৈকষ্য কুলীন' বাবুরামকে সঙ্গে সঙ্গে ফিরিতে হইত। ঠাকুর যদ্যপি অব্রাহ্মণের হস্তে অন্নগ্রহণ করিতে পারিতেন না, তথাপি বাবুরামের পবিত্রতা-সম্বন্ধে সন্দেহমাত্র না থাকায় এক সময় তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, “তুই আমায় একদিন রেঁধে দিস, তোর হাতে খাব।” অবশ্য কার্যত উহা আর ঘটিয়া উঠে নাই।


🌼প্রেমানন্দের প্রেম ভক্তসেবায় কোন বাধা মানিত না। কেহ মঠে আসিলে প্রসাদ না পাইয়া ফিরিতে পারিত না। একদিন জনৈক ভক্ত প্রসাদ না লইয়া চলিয়া যাইতেছেন দেখিয়া তিনি ঠাকুর-ভাণ্ডারীকে কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। তিনি বলিলেন, “ইনি একটুও দাঁড়ালেন না—কি করে প্রসাদ দিই?” বিরক্ত হইয়া প্রেমানন্দ উত্তর দিলেন, “তবু ডেকে এনে দিতে হয়—যখন মঠের ভেতর এসে পড়েছে। সংসারে থাকলে না নিজে খেতে পেতিস, না বাছাদের মুখে দুটো দিতে পারতিস। এখানে ঠাকুরের এত আসছে—হাতে করে তুলে দিতে পারবি নি?”


🌼মঠের রাস্তায় বাবুরাম মহারাজকে স্বহস্তে চোরকাঁটা উঠাইতে দেখিয়া জনৈক ভক্ত সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ, আপনি কেন এ কাজ করছেন?” প্রেমানন্দ অমনি উত্তর দিলেন, “ভক্তেরা কষ্ট করে আসে—অসুবিধা হয়; তাই তাদের পথের কাঁটা সরিয়ে দিচ্ছি।” কে জানে এই সামান্য চোরকাঁটার সঙ্গে তিনি কোন অজানা জগতের পথের কাঁটা সরাইতেছিলেন।


🌼উৎসবের দিনে মঠ প্রাঙ্গণে ভদ্রলোক, মুচি, মেথর, ধনী, দরিদ্র-নব নারায়ণই পঙ্ক্তিভোজনে বসিয়াছেন। খিচুড়ি পরিবেশন হইতেছে। তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত স্বামী প্রেমানন্দ দেখিলেন, দূরে এক পক্তি হইতে বারংবার খিচুড়ি দাও, খিচুড়ি দাও' এই রব উঠিতেছে। তিনি অবিলম্বে সেখানে উপস্থিত হইয়া পরিবেশককে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কি আর কখনো পরিবেশন করনি?” উত্তর পাইলেন, “আমি বার বার দিচ্ছি, তবু কুলাচ্ছে না; এরা দাও দাও বলে শুধু গোল করছে।” প্রেমানন্দ দেখিলেন, পঙ্ক্তির প্রায় সবই গরিব—ইহাদের অধিক আহার করাই অভ্যাস। তাই সমবেদনায় ব্যথিত হইয়া আবেগভরে বলিলেন, “আমাদের পেটের ওজনে কি এদের পেটের ওজন করা যায়! জানি না জীবনে কদিন এরা পেটভরে খেতে পায়—এদের পেটে যে দিনরাত আগুন জ্বলছে। যাও যাও, বালতিটা এদের এক এক পাতে ঢেলে দাও। ঠাকুরের প্রসাদ পেট ভরে খেয়ে নিক।” বলিতে বলিতে স্বর শুষ্ক হইয়া আসিল, নয়নকোণে বারি ঝরিয়া পড়িল—প্রেমানন্দ আর সামলাইতে না পারিয়া অন্যত্র চলিয়া গেলেন ।


🌼মহাসমাধির পূর্বে একদিন তিনি স্বামী সারদানন্দকে অন্যমনস্কভাবে বলিয়াছিলেন, “চাঁপা ফুলের মতো রং কাপড় পড়তে ইচ্ছা করে, আর বেলফুলের মতো ধবধবে অন্ন খেতে ইচ্ছা করে।” শুনিয়া এক পরিপক্ববুদ্ধি ব্রাহ্মণ চিত্তা করিয়াছিলেন, “আমরা গৃহস্থ, অত সব জোগাড় কি করে করব?” তিনি কি করিয়া জানিবেন যে, হ্লাদিনী শক্তি হইতে বিচ্ছুরিত হইয়া যে মূর্তি মর্তধামে ভগবৎ কার্যসাধনের জন্য এতকাল নিয়োজিত ছিলেন, আজ তিনি স্বরূপে লীন হইতে চাহেন?—বাবুরাম মহারাজ এই দৈব ভাষায় তারই পূর্বাভাস দিলেন মাত্র।


প্রেমানন্দ স্বামী প্রেমের হাট ভাঙ্গিয়া চলিয়া গেলেন। নিদারুণ সংবাদ চারিদিকে বিস্তৃত হইয়া সকলের মনে মর্মান্তিক আঘাত প্রদান করিল। পূজনীয় মাস্টার মহাশয় শুনিয়া বলিলেন, “ঠাকুরের প্রেমের দিকটা চলে গেল।” শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানী অশ্রুবিসর্জন করিতে করিতে বলিলেন, “মঠের শক্তি, ভক্তি, যুক্তি—সব আমার বাবুরামের রূপ ধরে মঠের গঙ্গাতীর আলো করে বেড়াত। হায়, ঠাকুর তাকেও নিয়ে গেলেন!” 

     🌼 *শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্তমালিকা*🌼


(★এরকম পোস্ট নিয়মিত পেতে ফেসবুক পেজটি ফলো করে রাখুন★)

দিব্যত্রয়ী - The Holy Trio

শ্রীরামকৃষ্ণ ও তোতাপুরী

  তো তাপুরী যখন দক্ষিণেশ্বরে এলেন তখন তিনি মধ্যবয়সী প্রৌঢ়, তিনি মন্দির চত্বরে পৌঁছেই প্রথমে গেলেন ঘাটের কাছে, সেখানে তখন অনেকেই বসে ছিলেন,...